বিঃদ্রঃ ইস্কনের ভক্ত ও প্রচারক পদ্মমুখ নিমাই দাস মূর্তিপূজার বেশ কিছু যুক্তি প্রদান করেছেন। এই লেখাতে সেই যুক্তিগুলো খণ্ডন করা হবে ইনশাআল্লাহ; তার যুক্তিগুলো এই লিঙ্কের ভিডিওতে গিয়ে দেখতে পারেন - https://youtu.be/1eWGiMtx2_E
.
.
যুক্তি ১:
৫০০ টাকার নোট একটা সাধারণ কাগজের টুকরো। কিন্তু সরকারের অনুমোদনের ফলে তার মূল্য অনেক। একইভাবে ভগবানের মূর্তি ভগবানের অনুমোদনের কারণে ভগবানের মতই সমতুল্য!
.
.
খণ্ডন ১:
যদি কোনো বইয়ের লেখককে প্রশ্ন করা হয়, "আপনাকে কে লিখেছে?" - এর অর্থ দাঁড়াবে, লেখক আসলে মানুষ নন, তিনি আসলে একটা বই। এখানে লেখক তার লেখা বই এর থেকেও উর্ধ্বে অবস্থিত। একইভাবে সরকার নিজে কাগজ বা ৫০০ টাকা নয়। তাই সরকার ৫০০ টাকার অনুমোদন দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, সরকার নিজেই ৫০০ টাকা বা কাগজের সমতুল্য! ৫০০ টাকার নোটের কাগজের টুকরোর অনুমোদন দেওয়ায় সরকার এখানে ৫০০ টাকার কাগজের চেয়েও উর্ধ্বে অবস্থিত! ঠিক একইভাবে, সৃষ্টিকর্তা যেহেতু এই জগতের স্রষ্টা, তাই অবশ্যই তাঁকে মূর্তি ও অন্যান্য সকল সৃষ্টির উর্ধ্বে অবস্থিত হতে হবে! ফলে মূর্তি আর স্রষ্টা সমতুল্য হতে পারে না!
وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌۢ
"আর তাঁর সমতুল্য কিছুই নেই।"
(আল-কোরআন ১১২:৪)
.
.
.
যুক্তি ২:
আপনি নিজে কোনো ছবি নন; কিন্তু তবুও কেউ আপনার ছবিকে অপমান করলে আপনি অপমানিত বোধ করেন! এখানে ছবি আপনার অস্তিত্বের থেকে ভিন্ন হলেও সেটি আপনাকে প্রকাশ করছে। একইভাবে ভগবানের মূর্তিও ভগবানের নিত্য রূপের এক বিশেষ প্রকাশ, যা ভগবানের অনুমোদন ক্রমেই পূজনীয়!
.
.
খণ্ডন ২:
মানুষ ও ছবি দুটোই ত্রিমাত্রিক (three dimensional) সৃষ্টি যাদের নিজস্ব ত্রিমাত্রিক আকার, আকৃতি, আয়তন রয়েছে। একারণে তাদের নিজস্ব প্রতিবিম্বও বিদ্যমান। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যদি সৃষ্টির মত এরূপ হন, তাহলে তিনি তখন আর সৃষ্টিকর্তাই থাকবেন না; কারণ তিনি তখন আসলে হবেন সৃষ্টিরই একটি অংশবিশেষ। যেহেতু সৃষ্টিকর্তা সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা, তাই অবশ্যই তাঁর প্রকৃতি সৃষ্টির ত্রিমাত্রিক প্রকৃতির থেকে উর্ধ্বতর ও ভিন্নতর হতে হবে। একারণে মানুষের প্রতিবিম্ব থেকে ছবি পাওয়া সম্ভব হলেও সৃষ্টিকর্তার এরূপ প্রতিবিম্ব ও সেই প্রতিবিম্বের প্রকাশস্বরূপ কোনো ছবি, মূর্তি ইত্যাদি পাওয়া সম্ভব নয়!! একারণে সৃষ্টিকর্তার মূর্তি বানানোর অর্থ হল, তাঁর প্রতি মিথ্যা বৈশিষ্ট্য আরোপ করা!!
"...যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করল, সে এক মহা অপবাদ আরোপ করল।" (আল-কোরআন ৪:৪৮)
خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ بِٱلْحَقِّۚ تَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ
"যিনি যথাবিধি আকাশরাজি ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি করেছেন। তারা যাকে শরীক করে তিনি তার বহু উর্ধ্বে।" (আল-কোরআন ১৬:৩)
.
.
.
যুক্তি ৩:
যেকোনো ডাকবাক্সে চিঠি ফেললেই তা কার্যকরী হয় না! আমি ঘরে একটি ডাকবক্স রেখে তাতে চিঠি ফেললে সেই চিঠি নির্দিষ্ট জায়গা মত পৌঁছাবে না। এজন্য কোনো ডাকবাক্স সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। তখন সেই ডাকবাক্সে চিঠি ফেললে চিঠি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাবে। একইভাবে যেকোনো রূপ নয়, বরং ভগবানের শাস্ত্র অনুমোদিত নিত্যরূপের ধ্যান করলে, ভগবান ভক্তের নিকট সেই নিত্যরূপে আবির্ভূত হন। তখন মূর্তি বা বিগ্রহের মধ্যে ভগবান সেই রূপে প্রকটিত হন!
.
.
খণ্ডন ৩:
প্রথমত সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব রূপ বিদ্যমান যেটা অবৈদিক একেশ্বরবাদ (Abrahamic Monotheism অর্থাৎ ইসলাম)-ও স্বীকার করে! কিন্তু সেই রূপ আকার বা নিরাকারের বৈশিষ্ট্যে পরিমাপযোগ্য নয়! কেননা আকার বা নিরাকার সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য (যেমন জল নিরাকার, বরফ আকারবিশিষ্ট), কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এই সকল কিছুরই স্রষ্টা! একজন বইয়ের লেখক যেমন বই এর কালি-পৃষ্ঠারও উর্ধ্বে, তেমনি সৃষ্টিকর্তাও সমস্ত সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যের উর্ধ্বে! একারণে সৃষ্টিকর্তার রূপ বা সুরতকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করে সেই রূপে মূর্তির ন্যায় কোনো সৃষ্টির মধ্যে তাঁর প্রকটিত হওয়া ও সেই রূপে ভক্তের নিকট আবির্ভূত হওয়ার দাবির অর্থ হল, তিনি আসলে সৃষ্টির সমতুল্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন! আর সৃষ্টির সমতুল্য কোনো কিছু সৃষ্টিরই অংশ হবে - এটাই যুক্তিসঙ্গত! আর সৃষ্টির অংশ হলে সেই অংশ কখনই প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা হতে পারে না!
"...কোনো কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন।" (আল-কোরআন ৪২:১১)
.
.
.
যুক্তি ৪:
প্রকৃতিতে অক্সিজেন-হাইড্রোজেন প্রভৃতি উপাদান ছড়িয়ে আছে। কিন্তু জল খাওয়ার জন্য অক্সিজেন-হাইড্রোজেন ইত্যাদির সঠিক মাত্রায় ও সঠিক নিয়মে মিলনের প্রয়োজন এবং এরপর সেই জল খাওয়ার জন্য টিউবয়েল, পাত্র ইত্যাদির প্রয়োজন। এই সঠিক পন্থার অবলম্বন না হলে শুধু হা করে থাকলেই জল মুখে এসে প্রবেশ করবে না। একইভাবে নেটওয়ার্কের ওয়েবও সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। কিন্তু টেলিভিশনের মত কোনো যন্ত্র না থাকলে আমরা অনুষ্ঠান দেখতে পারি না। একইভাবে ভগবান সর্বত্র বিরাজমান হওয়া সত্ত্বেও কেবল শুদ্ধ ভক্তরা ছাড়া সাধারণ লোকেরা তাকে দেখতে পায় না! তাই ভগবান সাধারণের জন্য মূর্তি বা বিগ্রহের মত পন্থা দেখিয়ে কৃপাস্বরূপ আমাদেরকে তার সান্নিধ্যে আসতে সাহায্য করেছেন!
.
.
খণ্ডন ৪:
অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ও তাদের মিলনে প্রাপ্ত রূপান্তরিত জল সবই একই সৃষ্টিজগতের অংশ! আবার ওয়েব, টেলিভিশন, টিউবওয়েল, পাত্র ইত্যাদি, অর্থাৎ প্রকৃতির সকল উপাদান ও উপাদানের রূপান্তরিত ফলাফল সবই আসলে অস্তিত্বের ভিত্তিতে নশ্বর সৃষ্টি! কিন্তু অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা হলেন অবিনশ্বর! সেক্ষেত্রে নশ্বর প্রকৃতির মূর্তির অস্তিত্ব এবং সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন অস্তিত্ব হওয়ায় মূর্তিকে পুজো করা সৃষ্টিকর্তার আরাধনার সমতুল্য হতে পারে না! আর যেহেতু মূর্তি স্রষ্টার সমতুল্য নয়, তাই মূর্তিপূজার পন্থাও সঠিক পন্থা হওয়া সম্ভব নয়; কেননা কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য যদি ভুল পথ বেছে নেওয়া হয়, তবে সেই গন্তব্যে পৌঁছানোও সম্ভব নয়!
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِنَّمَا ٱلْخَمْرُ وَٱلْمَيْسِرُ وَٱلْأَنصَابُ وَٱلْأَزْلَٰمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ ٱلشَّيْطَٰنِ فَٱجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
"হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি, ভাগ্য নির্ণয়ের তীর এগুলো বস্তুত শয়তানের এক একটি ঘৃণ্য কাজ; অতএব, এসব থেকে দূরে থাক, যাতে তোমরা সফল হতে পার।" (আল-কোরআন ৫:৯০)
নোট: ইসলামের অবৈদিক একেশ্বরবাদে স্রষ্টা সর্বত্র বিরাজমান নন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন এই লেখাটিতে:
সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি থেকে পৃথক - ইসলাম ও হিন্দুধর্মের তুলনা
.
.
.
যুক্তি ৫:
ওয়েবের সাহায্যে দুইজন ব্যক্তি পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থান করেও মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারে। একইভাবে টেলিভিশনে বা ফোনের সাহায্যে ইউটিউবে বহু দূরের ধারণকৃত অনুষ্ঠান বা লাইভ ভিডিও দেখা যায়। এভাবে ফোন, টিভি ইত্যাদি জড়-জাগতিক বস্তু (inert matter) এর মধ্যে যদি এরকম অচিন্ত্য শক্তির প্রকাশ দেখা যায়, তাহলে ভগবান কেন তার জাগতিক বিগ্রহ বা মূর্তির মাধ্যমে তার অচিন্ত্য শক্তি ও ভক্তের সাথে তার লীলাবিলাস প্রকাশ করতে পারেন না?
.
.
খণ্ডন ৫:
এটা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, পৌত্তলিকতায় চূড়ান্ত ঈশ্বর আসলে সৃষ্টির মত! সৃষ্টিজগতের ওয়েব তথা নেটওয়ার্কিং এর মত বিষয় এই সৃষ্টিজগতেরই অংশ; আর সৃষ্টিকর্তা এই সৃষ্টিজগতের কোনো কিছুর মত হওয়ার অর্থই হল, সেই স্রষ্টাও আসলে সৃষ্টিরই অংশ! আর সৃষ্টির কোনো অংশ প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা হতে পারে না! কেননা সেই অস্তিত্ব আসলে সৃষ্টিরই আওতাধীন!!!
وَٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةً لَّا يَخْلُقُونَ شَيْـًٔا وَهُمْ يُخْلَقُونَ وَلَا يَمْلِكُونَ لِأَنفُسِهِمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا وَلَا يَمْلِكُونَ مَوْتًا وَلَا حَيَوٰةً وَلَا نُشُورًا
"তারা তাঁর পরিবর্তে কত উপাস্য গ্রহণ করেছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না এবং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং নিজেদের ভালও করতে পারে না, মন্দও করতে পারে না এবং জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনের ও তারা মালিক নয়।" (আল-কোরআন, ২৫:৩)
.
.
- Ahmad Al-Ubaydullaah
====================
আরও পড়ুন:
Comments
Post a Comment