Skip to main content

ভগবতগীতার বর্ণভেদ নিয়ে ভক্তদের ভণ্ডামির জবাব



============================
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ৷
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্৷৷১৩

অর্থ:  "প্রকৃতির তিনটি গুণ এবং কর্ম অনুসারে আমি মনুষ্য সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমিই এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।" (ভগবতগীতা ৪:১৩)

এখানে কৃষ্ণ নিজেকে চার বর্ণের স্রষ্টা হিসেবে দাবি করছেন। এক্ষেত্রে ভক্তগণ এখানে এটা দাবি করে থাকে যে, এখানে এই বর্ণভেদ আসলে কোনো বিভেদ নয়, এটা গুণ এবং কর্ম অনুসারে কেবল সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে নির্দেশ করে। কিন্তু ব্যাপারটা এতটাই সামান্য নয়। ভক্তগণ এখানে একটা বড় বিষয় এড়িয়ে যায়। আর তা হল এই গুণ ও কর্ম তাদের জন্মান্তর থিওরি অনুযায়ী পূর্ব জন্মের অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত। যেমন গীতার আরেক জায়গায় বলা হচ্ছে,

দৈবী সম্পদ্বিমোক্ষায় নিবন্ধায়াসুরী মতা৷
মা শুচঃ সম্পদং দৈবীমভিজাতোসি পাণ্ডব৷৷৫॥

অর্থ: "দৈবী গুণাবলী মুক্তির অনুকূল আর আসুরীক গুণাবলী সংসার বন্ধনের কারণ। হে পান্ডুপুত্র, তুমি শোক করোনা কারণ তুমি দৈবী গুণাবলীতে বিভূষিত হয়ে জন্মগ্রহণ করেছ।" (ভগবতগীতা ১৬:৫)

এখানে অর্জুনকে বলা হচ্ছে যে, সে দৈবী গুণাবলীতে বিভূষিত হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। আর অর্জুনের বহু জন্মের উল্লেখ করে কৃষ্ণ অন্য স্থানে বলছেন, "হে পরন্তপ অর্জুন, আমার এবং তোমার বহুজন্ম অতীত হয়েছে; আমি সে সমস্ত জন্মের কথা মনে করতে পারি, তুমি তা পার না।" (ভগবতগীতা ৪:৫)

অর্থাৎ ভগবতগীতা ১৬:৫ এবং ৪:৫ অনুযায়ী বলা যায় যে, অর্জুনের বহু জন্ম পার হওয়ার অর্থ হল, অর্জুনের পূর্বজন্ম রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় আর অর্জুনের দৈবী গুণাবলী নিয়ে জন্মগ্রহণ নির্ধারিত হয়েছে আগের জন্মের অবস্থা অনুযায়ী। একইভাবে পূর্ব জন্মের কর্ম ও অবস্থা অনুযায়ী কেউ জন্ম থেকে ব্রাক্ষণ বা ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বা শূদ্র হয়ে জন্মাবে।

এই বিষয়টিকে আচার্য রামানুজ গীতার ১৮ অধ্যায়ের ৪১ নং শ্লোকের মন্তব্যে উল্লেখ করে বলেন,
"The word svabhava means one's inherent nature. This inherent nature arises from samskaras or past impressions and karma or reactions from past actions and is the root cause of determining birth as a Brahmin..."
(Ramanuja's Commentary on Gita 18.41) source - https://bit.ly/2Twto2c

এক্ষেত্রে তাই কেউ বর্ণ পরিবর্তন করতে পারবে না আর সেই বর্ণের বাইরেও যেতে পারবে না যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে ও পরবর্তীতে আবার জন্মগ্রহণ করে জন্মান্তরের থিওরি অনুযায়ী। আর যেহেতু কেউ বর্ণ পরিবর্তন করতে পারবে না, তাই বর্ণ অনুযায়ী জন্ম থেকে প্রাপ্ত স্বভাবজাত বর্ণ অনুযায়ী নির্ধারিত কর্মের বাইরে সে যেতে পারবে না। কৃষ্ণ এখানে এই গণ্ডিগুলো এভাবে উল্লেখ করেছেন,

"স্বভাবজাত গুণ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এবং শুদ্রেরও কর্মসমূহ পৃথক ভাবে বিভক্ত আছে। শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষান্তি, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য এই কয়টি ব্রাহ্মণদের স্বভাবজাত কর্ম। শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, দানশীলতা ও শাসন ক্ষমতা এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম। কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য এই কয়টি বৈশ্যের স্বাভাবিক কর্ম। পরিচর্যা শুদ্রের স্বভাবজাত কর্ম।" (ভগবতগীতা ১৮:৪১-৪৪)

কৃষ্ণ এই বর্ণ নির্ধারিত বিষয়কে স্বধর্ম বলে অভিহিত করে বলছেন যে, এই বর্ণ নির্ধারিত স্বধর্ম পালনই সঠিক পন্থা আর এতেই অবিচল থাকলে পাপ হয় না। এমনকি এতে অবিচল না থেকে ভিন্ন বর্ণের ধর্মাচারে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে মৃত্যু পর্যন্ত শ্রেয়।

শ্রেয়ান্স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাত্স্বনুষ্ঠিতাত্৷
স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্৷৷৪৭
সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেত্৷
সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ৷৷৪৮
অর্থ: "উত্তম রূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে অসম্যক রূপে অনুষ্ঠিত স্বধর্ম শ্রেয়। কারণ স্বভাব অনুসারে কর্ম করলে মানুষ পাপের ভাগী হয় না। প্রতিটি কর্ম প্রচেষ্টাতেই-কিছুনা কিছু দোষ থাকে, ঠিক যেমন অগ্নি ধূমের দ্বারা আবৃত থাকে। তাই হে কৌন্তেয়, দোষযুক্ত হলেও স্বধর্ম কখনও ত্যাগ করা উচিৎ নয়।" (ভগবতগীতা ১৮:৪৭-৪৮)

শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাত্ স্বনুষ্ঠিতাত্৷
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ৷৷৩৫
অর্থ:  "স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয় তাও মঙ্গলজনক কিংবা অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপদজনক।" (ভগবতগীতা ৩:৩৫)

এই প্রসঙ্গে দুই ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের মিলন তথা বিবাহাদিকে "ব্যভিচার" হিসেবে উল্লেখ করে গীতায় একে অর্জুনের মুখ থেকে নিন্দনীয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এবং এই ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের মিলনে উৎপাদিত সন্তানকে "বর্ণসঙ্কর" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

অধর্মাভিভবাত্কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ৷
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ৷৷৪১।
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ৷
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ৷৷৪২।

অর্থ:  "হে কৃষ্ণ, অধর্মের দ্বারা অভিভূত হলে কুলবধুগণ ব্যভিচারে প্রবৃত্ত হয় এবং কুলস্ত্রীগণ অসৎচরিত্রা হলে অবাঞ্চিত প্রজাতি উৎপন্ন হয়। অবাঞ্চিত বর্ণ সঙ্কর সন্তান উৎপাদন বৃদ্ধি হলে কুল ও কুলঘাতকেরা নরকগামী হয়। সেই কুলে পিন্ডদান ও তর্পণক্রিয়া লোপ পাওয়ার ফলে তাদের পিতৃপুরুষেরাও নরকে অধঃপাতিত হয়।" (ভগবতগীতা ১:৪১-৪২)

এই "ব্যভিচার" অর্থ যে intermingling/intermixing of castes বা ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের মিলন, তা বিভিন্ন হিন্দু পণ্ডিতগণের গীতার এই শ্লোক (প্রথম অধ্যায়ের ৪১ নং শ্লোক) এর ওপর মন্তব্য থেকেই পুরো স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

পণ্ডিত শ্রীধর স্বামীর মন্তব্য:
"When this happens there is an **intermingling of castes** (ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের মিলন) and the ancestors of these destroyers of the family fall from heaven..." (Sridhara Swami's Commentary on Bhagavad Gita 1.41) source - https://bit.ly/2H4MV4O

পণ্ডিত বলদেব বিদ্যাভূষণের মন্তব্য:
"When there is a resultant **intermixture of castes** (ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের মিলন) due to the destruction of the family structure; those who are responsible are damned to hell; but not only these ruinous family members. Their forefathers are also sent to hell as well due to the cessation of the ritual offerings of food and water that are no longer given due to the fact that there no longer exist any male descendants to perform such rites." (Baladeva Vidyabhusana's Commentary on Bhagavad Gita 1.41) source - https://bit.ly/2H4MV4O

পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরীর মন্তব্য:
"...The intermixture of castes (ভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষের মিলন) that follow the family customs and honor the age-old Vedic traditions with those that do not causes a degradation in society and leads the family to a hellish existence..." (Kesava Kasmiri's Commentary on Bhagavad Gita 1.41) source - https://bit.ly/2H4MV4O

এছাড়া ভগবতগীতার নবম অধ্যায়ের ৩২ নং শ্লোকে কৃষ্ণ নিজেই নারী, বৈশ্য এবং শূদ্র জাতিকে নিম্নবর্ণের বলে উল্লেখ করেছেন।

মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ৷
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেপি যান্তি পরাং গতিম্৷৷৩২

অর্থ: "হে পার্থ, স্ত্রীলোক, বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি নিম্নবর্ণের মানুষেরা আমার অনন্য ভক্তিকে বিশেষ ভাবে আশ্রয় করলে অবিলম্বে পরাগতি লাভ করে।" (ভগবতগীতা  ৯:৩২)

এই শ্লোকের মন্তব্যে স্বামী স্বরূপানন্দ উল্লেখ করেন যে, স্বাভাবিকভাবে নারী ও শূদ্র এর জন্য বেদ অধ্যয়ন নিষিদ্ধ:
"Of inferior birth . . . Sudras—Because by birth, the Vaishyas are engaged only in agriculture &c., and the women and Sudras are debarred from the study of the Vedas."
(Swami Swarupananda's Commentary on Gita 9.32) source - https://bit.ly/31B762f

আদি শঙ্করাচার্যও গীতার নবম অধ্যায়ের ৪১ নং শ্লোকের টীকাতে শূদ্রদের জন্য বেদ অধ্যয়ন নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করছেন।

“Sudras are separated from others - who are all mentioned together in one compound word - because Sudras are of one birth and are debarred from the study of the Vedas…”
(Adi Shankaracharya's Commentary on Gita 18.41) source - https://bit.ly/31CAogP

এছাড়া গীতার ১৮ অধ্যায়ের ৪১ নং শ্লোকের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পণ্ডিত শ্রীধর স্বামী ও কেশব কাশ্মীরি আরও উল্লেখ করছেন যে, শূদ্র বৈদিক আচারসমূহ হতে প্রত্যাখ্যাত!

"...sudra or menial worker class which is the only one not qualified to take part in any Vedic activity as they serve the other three classes..."
(Sridhara Swami's Commentary on Gita 18.41) source - https://bit.ly/2Twto2c

"...sudra or servant class are mentioned separately as they have not the qualification for initiation and study of the Vedic scriptures but all are factually the product of their own innate natures.... It is prohibited in the Vedic scripture to initiate a sudra. If done it will bring calamity upon the spiritual master, his dynasty and the whole kingdom..." (Kesava Kasmiri's Commentary on Gita 18.41) source - https://bit.ly/2Twto2c

মনুসংহিতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৪১ নং শ্লোকের ভাষ্যতে মেধাতিথি উল্লেখ করেছেন যে, শূদ্রের জন্য বেদ অধ্যয়ন নিষিদ্ধ এবং স্বাভাবিকভাবে শূদ্র যদি বেদ অধ্যয়ন করে, তবে তার দেহ কেটে ফেলতে হবে।

"...for the Śūdra is not entitled to learn the Veda; and it is only when one has learnt something that he can teach it.... This also cannot be; because it has been laid down that if the Śūdra happens to learn the Veda, his body should be cut up..."

[Medhātithi’s commentary (manubhāṣya) on Manusmriti 2.241] source - https://bit.ly/2TuFHfD

Comments

Popular posts from this blog

মানহাজ ও মাযাহাব নিয়ে যত দ্বন্দ্বের জবাব....

[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...

কৃষ্ণ কি আল্লাহর নবী ছিল?

এই প্রশ্নটা আমাকেও করা হয়েছে সম্ভবত কয়েকবার। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরটা বড়ই জটিল। কারণ এর কোনো যথাযথ উত্তর আমাদের জানা নেই। যদি কৃষ্ণের গোপীদের সাথে লীলার কাজকে সত্য বলে...