Skip to main content

শর্তহীন ভালবাসা???


মহান আল্লাহ কুরআনুল কারীমের এক স্থানে বলেন,

لَّا يَتَّخِذِ ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلْكَٰفِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ ٱللَّهِ فِى شَىْءٍ إِلَّآ أَن تَتَّقُوا۟ مِنْهُمْ تُقَىٰةًۗ وَيُحَذِّرُكُمُ ٱللَّهُ نَفْسَهُۥۗ وَإِلَى ٱللَّهِ ٱلْمَصِيرُ

"মু’মিনগণ যেন মু’মিনগণকে ছেড়ে কাফিরদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ না করে, এবং তাদের আশংকা হতে আত্মরক্ষা ব্যতীত যে এরূপ করে সে আল্লাহর নিকট সম্পর্কহীন; আর আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় পবিত্র অস্তিত্বের ভয় প্রদর্শন করছেন এবং আল্লাহরই দিকে ফিরে যেতে হবে।"
(আল-কোরআন ৩:২৮)

এখানে এই ধরণের আয়াতগুলো থেকে একটি শর্তযুক্ত ভালবাসার প্রসঙ্গ উঠে আসে। আর সেই শর্ত হল ঈমানের উপস্থিতি। অর্থাৎ কাউকে ভালবাসা, কারও সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব রাখা ইত্যাদির পূর্বশর্তই হল ঈমানের আবশ্যকতা। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে তিনটি গুণের জন্য কেউ ঈমানের সুস্বাদ পায়, তার একটি হল "কাউকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালবাসা" (সহীহ বুখারী (তাওহীদ)/হাঃ ১৬)। অর্থাৎ একজন মুমিন ব্যক্তি সেভাবে একজন কাফির বা অবিশ্বাসী ব্যক্তিকে ভালবাসতে পারে না, যেভাবে সে অপর আরেক মুমিন ব্যক্তিকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসে; কেননা এখানে ভালবাসার ভিত্তি ও পূর্বশর্তই হল ঈমান।

এমনকি কোরআনে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

مَن كَانَ عَدُوًّا لِّلَّهِ وَمَلَٰٓئِكَتِهِۦ وَرُسُلِهِۦ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَىٰلَ فَإِنَّ ٱللَّهَ عَدُوٌّ لِّلْكَٰفِرِينَ

"যে ব্যক্তি আল্লাহর, তাঁর ফেরেশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের, জিবরাঈলের এবং মিকাঈলের শত্রু, নিশ্চয়ই আল্লাহ এরূপ কাফিরদের শত্রু।"
(আল-কোরআন ২:৯৮)

অর্থাৎ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিরুদ্ধাচারণকারী অবিশ্বাসী ব্যক্তিদের আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন না!!

এখন স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন আসতে পারে - এমনটা কেনই বা হবে?

মহান আল্লাহ যিনি সমস্ত জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা; যাঁর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই; তিনি কেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে পরস্পারিক ভালবাসার ক্ষেত্রে এরূপ পক্ষপাতমূলক শিক্ষা দিচ্ছেন ও নিজেও এরূপ পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন? (নাউযুবিল্লাহ)

বিষয়টি মূলত অবিশ্বাসীদের মনে বেশি আসে আর কিছু মুসলিমদের মনেও হয়ত আসতে পারে!

তবে এখানে প্রথমেই বলে রাখি যে, "পক্ষপাতিত্ব" এর ন্যায় প্রকাশভঙ্গি প্রকৃতপক্ষে মূল বিষয়কে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম নয়!

ব্যাপারটিকে সহজ করার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করছি। মনে করুন, আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার বাড়িতে এসে একদল লোক ঢুকে ভাঙচুর শুরু করল; ঘরের মেয়ে-মহিলাদের ধর্ষণ করল আর তারপর সকলকে হত্যা করে পেট্রোল ঢেলে বাড়িখানা জ্বালিয়ে দিল! এবার আপনি নিশ্চয়ই সেই দলের লোকগুলোকে ভালবেসে জড়িয়ে ধরবেন??

আশা করি আপনার বুদ্ধি বিবেক ঠিক থাকলে তাদেরকে ভালবেসে জড়িয়ে ধরা তো দূরে থাক, তাদেরকে যথাযথ শাস্তি প্রদানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা থেকেও আপনি পিছপা হবেন না!

এখন আপনি যে এই দুষ্কৃতিগুলোকে ভালবাসতে পারছেন না, এর পিছনে কারণ হল, তারা আপনার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে আপনার ওপর অত্যাচার করেছে!! তাই এখানে আপনার তাদেরকে না ভালবাসার পিছনে যে শর্তটি কাজ করছে, তা হল তাদের দ্বারা কৃত অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ না করতে পারা!

অর্থাৎ, এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, যদি ভালবাসা শর্তহীন বা unconditional হয়ে পড়ে, তবে অন্যায়, অবিচার ও অরাজকতার উত্থান ঘটবে।

একারণে শর্তহীন ভালবাসা কখনই ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না!

আর ঠিক একারণেই ন্যায়সংগত হল শর্তযুক্ত ভালবাসা বা conditional love; সেক্ষেত্রে ভালবাসার ভিত্তি দাঁড়িয়ে থাকবে নির্দিষ্ট শর্তের ওপর। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শর্ত আর স্বার্থ এখানে এক বিষয় নয়! কাউকে কোনো প্রয়োজন পূরণের জন্য ভালবাসা হল স্বার্থযুক্ত ভালবাসা। যেমন দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্ক ভাল। কিন্তু কেবল সুসময়েই তারা বন্ধু। বিপদে পড়লে তারা কেউ কারও পাশে থাকে না! এটা একপ্রকার স্বার্থযুক্ত ভালবাসার প্রকাশ। অর্থাৎ স্বার্থযুক্ত ভালবাসা হচ্ছে এক ধরণের ভণ্ডামি যেখানে বাহ্যিকভাবে ভালবাসা দেখানো হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে কাজ করে প্রয়োজন পূরণের বাসনা।

অন্যদিকে শর্তযুক্ত ভালবাসা স্বার্থযুক্ত ও স্বার্থহীন দুটোই হতে পারে। যদি ভালবাসার পূর্বশর্তই হয় স্বার্থ মেটানোর বাসনা, তবে সেই শর্তযুক্ত ভালবাসা স্বার্থযুক্ত হয়ে উঠবে। অন্যদিকে ভালবাসার পূর্বশর্ত যদি স্বার্থ পূরণ করা না হয়, তবে সেই শর্তযুক্ত ভালবাসার ভিত্তি হবে অন্য কিছু। যেমন, কোনো মা তার সন্তানকে একারণে ভালবাসে না যে, সন্তানের মাধ্যমে সে নিজের বস্তুগত স্বার্থ পূরণ করবে; এখানে হয়ত মাতৃত্ব এর দাবিতে মায়ের কিছু স্বার্থ কাজ করতে পারে, কিন্তু মূল বিচার্য বিষয়ে নজর দিলে আমরা দেখব যে, এখানে মূল ভালবাসার ভিত্তি পার্থিব স্বার্থ নয়, বরং মাতৃত্ব!

এই বিষয়টি যদি সঠিকভাবে বোঝা যায়, তবে এক্ষেত্রে আমরা এই স্বার্থহীন শর্তযুক্ত ভালবাসার কথাই বিবেচনায় আনতে চাইছি।

এই সৃষ্টিজগতে যেহেতু সৃষ্টিসমূহ পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, তাই তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা পুরোপুরি স্বার্থমুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হলেন আস-সামাদ; তিনি সকল কিছুর অমুখাপেক্ষী! তাই আল্লাহ তাআলার কোনো রূপ নির্ভরশীলতা বা প্রয়োজন পূরণের স্বার্থ নেই!

কিন্তু এখানে মূল ভিত্তিকে বিবেচনা করলে যেটা পাওয়া যাবে সেটা হল "শর্ত"। অর্থাৎ স্বার্থভিত্তিক না হয়ে শর্তভিত্তিক হওয়া।

পূর্বেই আমরা দেখিয়েছি যে, ভালবাসা যদি শর্তহীন বা শর্তমুক্ত হয়, তবে সেখানে অন্যায়, অবিচার, অরাজকতার উত্থান ঘটবে! এখানে ভালবাসা ন্যায়সংগত হতে হলে তা শর্তযুক্ত হতে হবে।

সেখানে যেহেতু মহান আল্লাহ এই সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক, তাই তিনিই এই জগতের সকল প্রাকৃতিক নিয়ম, হালাল-হারামকে নির্দিষ্ট করবেন! আর একারণেই এই নিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থানের মাধ্যমে সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধাচরণের ফলে উত্থান ঘটবে অন্যায়, অবিচার, অরাজকতা! এক্ষেত্রে তাই স্রষ্টার নির্ধারিত বিষয়কে অস্বীকার করার অর্থই হল স্রষ্টার নির্ধারিত শর্তকে উপেক্ষা করে নিজের প্রতি জুলুম করা। আর যখন স্রষ্টা নির্ধারিত পূর্বশর্তকে লঙ্ঘন করা হবে, তখন সেই ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা প্রকাশের অর্থই হবে শর্তহীন ভালবাসা! আর শর্তহীন ভালবাসার অর্থ হল অন্যায়, অবিচার ও অরাজকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া! কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ হলেন সবচেয়ে ন্যায়বিচারক। একারণে তিনি কখনই অনায়, অবিচারক, অরাজকতাকে প্রশ্রয় দিতে পারেন না।

একারণে আল্লাহ তাআলার ভালবাসা স্বার্থমুক্ত হলেও তা শর্তযুক্ত! আর এই শর্তযুক্ত ভালবাসার কারণেই তিনি মানুষকে নিদর্শন দেখাচ্ছেন শর্তযুক্ত সেই ভালবাসার পথে আসতে যেখানে ভালবাসার পূর্বশর্ত হবে ঈমান; আল্লাহর নাফরমানি, কুফরি ইত্যাদি জাতীয় কোনো বিষয় নয়!

আল্লাহই ভাল জানেন।

(কোনোরূপ ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহ মার্জনা করুন ও আমাদের সকলকে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করুন। আমিন।)

- আহমাদ আল-উবায়দুল্লাহ
===============================

আরও পড়ুন:
আল্লাহ তাআলার বিরুদ্ধে কেন বলা যাবে না? আর কেন আল্লাহ তাআলার বিরুদ্ধে গেলে আল্লাহ রেগে যান? এর অর্থ কি আল্লাহ সৃষ্টির মুখাপেক্ষী নন?

Comments

Popular posts from this blog

মানহাজ ও মাযাহাব নিয়ে যত দ্বন্দ্বের জবাব....

[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...

কৃষ্ণ কি আল্লাহর নবী ছিল?

এই প্রশ্নটা আমাকেও করা হয়েছে সম্ভবত কয়েকবার। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরটা বড়ই জটিল। কারণ এর কোনো যথাযথ উত্তর আমাদের জানা নেই। যদি কৃষ্ণের গোপীদের সাথে লীলার কাজকে সত্য বলে...

ভগবতগীতার বর্ণভেদ নিয়ে ভক্তদের ভণ্ডামির জবাব

============================ চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ৷ তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্৷৷১৩ অর্থ:  "প্রকৃতির তিনটি গুণ এবং কর্ম অনুসারে আমি মনুষ্য সমাজে চারটি বর্ণ...