রবীন্দ্রনাথের এই গানটি বৈশাখের আগমনে প্রায়ই গাওয়া হয়। গানের কথাগুলো নিম্নে দেওয়া হলঃ
.
"এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥"
[রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২০ ফাল্গুন, ১৩৩৩
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ৪ মার্চ, ১৯২৭
রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর]
source - https://blnk.in/HtKORd
.
.
আমি আমার বোধগম্যতা থেকে এর মধ্য থেকে ইসলামিক বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো বলার চেষ্টা করছি।
.
প্রথমেই দেখুন বলা হয়েছে, "এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ"। এখানে বৈশাখকে আহবান করা হচ্ছে আগমনের জন্য। স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধির কেউ ভেবে দেখলে সে বুঝবে যে, বৈশাখ একটি বিমূর্ত (abstract) ধারণা মাত্র যা প্রকৃতপক্ষে একটি মাস এর নামকে বোঝাচ্ছে। এর কোনো শারীরিক অস্তিত্ব (physical existence) বা অশীরীরি আত্মিক অস্তিত্বও (spiritual existence) নেই। এটা কেবল একটি মানসিক ধারণা মাত্র যে, "বৈশাখ" হল একটি মাসের নাম যা বাংলা বছরের প্রারম্ভকে সূচনা করছে মাত্র। এক্ষেত্রে তাই বৈশাখের সম্বোধনে বৈশাখ আসলে কোনো কিছুই শোনার সামর্থ্য রাখে না। তাহলে এখানে এরূপ সম্বোধনের উদ্দেশ্য কী? এটি বুঝতে দেখুন পরবর্তীতে বলা হচ্ছে, "তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥"
অর্থাৎ বৈশাখের মুহূর্তে প্রার্থনা করা হচ্ছে যাতে "মুমূর্ষুরে" অর্থাৎ 'রোগ-ব্যাধি' দূর হয়ে যায়, "বৎসরের আবর্জনা" দূর হয়ে পরিবেশ নির্মল হয়ে যায়। লক্ষ্যণীয় যে, এখানে প্রার্থনা কাকে সম্বোধন করে করা হচ্ছে? বৈশাখকে! কিন্তু বৈশাখ তো একটি মাস মাত্র; তাহলে প্রার্থনাটি কার উদ্দেশ্যে? প্রার্থনাটি আসলে প্রকৃতির উদ্দেশ্যে! এখানে বৈশাখকে আহবান করা হচ্ছে আগমনের জন্য, অর্থাৎ এখানে বছরের প্রারম্ভের সময়কে নির্দেশ করা হচ্ছে, আর এই সময় প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা জানানো হচ্ছে যেন রোগ-ব্যাধি দূর হয়ে যায় এবং পরিবেশ নির্মল হয়ে যায়। আর এখানে তাই এটা স্পষ্ট প্রকৃতিপূজা অর্থাৎ পৌত্তলিকতা বা Paganism; আর মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন,
.
وَمَثَلُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ كَمَثَلِ ٱلَّذِى يَنْعِقُ بِمَا لَا يَسْمَعُ إِلَّا دُعَآءً وَنِدَآءًۚ صُمٌّۢ بُكْمٌ عُمْىٌ فَهُمْ لَا يَعْقِلُونَ
.
"আর যারা অবিশ্বাস করেছে তাদের দৃষ্টান্ত ওদের ন্যায় - যেমন কেহ আহবান করলে শুধু চীৎকার ও ধ্বনি ব্যতীত আর কিছুই শোনে না, তারা বধির, মুক, অন্ধ; কাজেই তারা বুঝতে পারে না।" (আল-কোরআন, ২:১৭১)
পরবর্তীতে বলা হচ্ছে,
"যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।"
এখানে পুরোনো দিনের স্মৃতি দুঃখ-কষ্ট ও গ্লানির বিষয়গুলোকে ভুলে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে এবং সেটি দূর হয়ে যাওয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, "অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা"। এখানে "শুচি হোক ধরা" বলতে মানসিক ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতার ইঙ্গিত আমরা পাই, অর্থাৎ পূর্বের সকল নেতিবাচক বিষয়কে ভুলে পবিত্র, শুদ্ধ হওয়ার আহবান জানানো হচ্ছে "অগ্নিস্নান" অর্থাৎ আগুনের স্পর্শের মাধ্যমে, যা পরোক্ষভাবে অগ্নিদেবতাকে নির্দেশ করছে। পুজোর পর আগুনের স্পর্শ নেওয়া হয় যেখানে অগ্নিদেবতার মাধ্যমে অশুচি দূর করার একটি চিন্তা থাকে। একইভাবে এখানে "অগ্নিস্নান"-এ অগ্নিদেবতার প্রতি বন্দনার পরোক্ষ যোগ রয়েছে যা আরেকটি পৌত্তলিকতার দিক তুলে ধরছে। মহান আল্লাহ বলেন,
أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلْخَالِصُۚ وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِهِۦٓ أَوْلِيَآءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلْفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِى مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِى مَنْ هُوَ كَٰذِبٌ كَفَّارٌ
"জেনে রেখ, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে তারা বলেঃ আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্য এনে দিবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তার ফাইসালা করে দিবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, আল্লাহ তাকে সৎ পথে পরিচালিত করেন না।" (আল-কোরআন, ৩৯:৩)
.
সবশেষে বলা হচ্ছে,
"রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,/আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।/মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥"
এখানে "রসের আবেশরাশি" বলতে পার্থিব আসক্তির কথা বলা হচ্ছে এবং "প্রলয়ের শাঁখ" অর্থাৎ একে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে বিষয়টিকে নিলে ব্যাপারটি এমনভাবে বলা যেতে পারে যে, প্রবৃত্তির সাথে লড়াই করে পার্থিব সমস্ত আসক্তি থেকে দূর হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হচ্ছে। একে হিন্দু দর্শনে বলা হয়েছে "মোক্ষ" বা "মুক্তি" লাভ; বৌদ্ধ দর্শনে "নির্বাণ" প্রাপ্তি। আর এভাবে "মায়ার কুজ্ঝটিজাল" দূর হয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এখানে "মায়া" অর্থ হল মিথ্যা। আদি শংকরাচার্যের মায়াবাদ অনুসারে, এই জগত হল মায়া অর্থাৎ মিথ্যা, আর এই মিথ্যা জগতের অনুভূতি কেবল আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। তাই প্রবৃত্তির মাধ্যমে এই জগতের প্রতি আসক্তিও এক ধরণের মনের মধ্যে আমাদের মিথ্যা কল্পনার জগৎ যা থেকে বেরিয়ে মুক্ত হওয়ার আহবান জানানো হচ্ছে।
অথচ ইসলাম অনুযায়ী এই দুনিয়ার জগৎ বাস্তব এবং এখানে পার্থিব আকাঙ্ক্ষা থেকে বের হওয়া শরীয়ত সম্মত নয়। বরং শরীয়তে ভোগ-বিলাসিতার ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী চলা ও সেই গণ্ডিতেই আল্লাহর ইবাদত করা ও তাঁর নিকট প্রার্থনাতেই প্রকৃত মুক্তি নিহিত যা বৈশাখের উক্ত আহবানের সম্পূর্ণ বিপরীত। মহান আল্লাহ তাআলা এই জগতের বাস্তবতা বা সত্যতা নির্দেশ করতে গিয়ে এরশাদ করেন,
وَلَوْ تَرَىٰٓ إِذْ وُقِفُوا۟ عَلَىٰ رَبِّهِمْۚ قَالَ أَلَيْسَ هَٰذَا بِٱلْحَقِّۚ قَالُوا۟ بَلَىٰ وَرَبِّنَاۚ قَالَ فَذُوقُوا۟ ٱلْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ
"হায়! তুমি যদি সেই দৃশ্যটি দেখতে, যখন তাদেরকে তাদের রবের সম্মুখে দন্ডায়মান করা হবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞেস করবেনঃ এটা (কিয়ামাত) কি সত্য নয়? তখন তারা উত্তরে বলবেঃ হ্যাঁ, আমরা আমাদের রবের (আল্লাহর) শপথ করে বলছি! এটা বাস্তব ও সত্য বিষয়। তখন আল্লাহ বলবেনঃ তাহলে তোমরা এটাকে অস্বীকার ও অমান্য করার ফল স্বরূপ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ কর।" (আল-কোরআন, ৬:৩০)
.
.
وَيَوْمَ يُعْرَضُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ عَلَى ٱلنَّارِ أَلَيْسَ هَٰذَا بِٱلْحَقِّۖ قَالُوا۟ بَلَىٰ وَرَبِّنَاۚ قَالَ فَذُوقُوا۟ ٱلْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ
"যেদিন কাফিরদেরকে উপস্থিত করা হবে জাহান্নামের নিকট, সেদিন তাদেরকে বলা হবেঃ এটা কি সত্য নয়? তারা বলবেঃ আমাদের রবের শপথ! এটা সত্য। তখন তাদেরকে বলা হবেঃ শাস্তি আস্বাদান কর। কারণ তোমরা ছিলে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী।" (আল-কোরআন, ৪৬:৩৪)
.
.
فَوَرَبِّ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ إِنَّهُۥ لَحَقٌّ مِّثْلَ مَآ أَنَّكُمْ تَنطِقُونَ
.
"আকাশ ও যমীনের প্রতিপালকের শপথ! এ সব অবশ্যই সত্য, এমনই দৃঢ় সত্য যেমন তোমরা (যে কথাবার্তা) বলে থাক (সেই কথাবার্তা বলার ব্যাপারটা যেমন নিঃসন্দেহে সত্য)।" (আল-কোরআন, ৫১:২৩)
.
.
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, নববর্ষের সাথে জড়িত বৈশাখের আহবান পুরোপুরি শির্ক ও কুফরের একটি সম্মিলিত concept যা থেকে দূরে থাকা মুসলিমদের জন্য আবশ্যিক।
.
আল্লাহই ভাল জানেন।
- Ahmad Al-Ubaydullaah
Comments
Post a Comment