এই বিষয়টি নিয়ে আজকাল মুসলিমরা এত বেশি মেতে উঠেছে যে, এই বিষয়ে কিছু না লিখে থাকতে পারলাম না।
.
এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হল, না, মূর্তিপূজা হিন্দুধর্মে নিষিদ্ধ নয়। এটা অনুমোদিত।
.
তবে এই বিষয়টিকে বিশদে বলার আগে আমি আগেই বলে রাখি যে, কোনো ইসলামিক দাঈ বা বিশেষজ্ঞকে ভুল বা ঠিক প্রমাণের জন্য আমি কিছু লিখছি না। বরং আমি কেবল আমার দৃষ্টিভঙ্গিই তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এখানে আমি কেবল হিন্দু দর্শনের আলোকে বিষয়টি বলার চেষ্টা করলাম। পাঠকরাই বিচার করে দেখবেন, কোন্ ব্যাখ্যাটি সঠিক।
.
হিন্দু দর্শনের মূলে রয়েছে দুটি তত্ত্ব:
১) দ্বৈতবাদ,
২) অদ্বৈতবাদ।
.
দ্বৈতবাদ হল সেই ধারণা যখন ব্যক্তির এই উপলব্ধি জন্মায় যে, ঈশ্বর এবং সৃষ্টি হল পৃথক অস্তিত্ব।
.
আর অদ্বৈতবাদ হল সেই ধারণা যখন ব্যক্তির এই উপলব্ধি সৃষ্টি হয় যে, ঈশ্বর এবং সৃষ্টি হল একই অস্তিত্ব।
.
ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান - এই মুশরিকি ধারণাটি এসেছে অদ্বৈতবাদ থেকে। অদ্বৈতবাদ এর ক্ষেত্রে দুটি ক্রমশ চূড়ান্ত পর্যায় রয়েছে:
১) স্ববিকল্প সমাধি,
২) নির্বিকল্প সমাধি।
.
স্ববিকল্প সমাধি হল সেই স্তর যখন ব্যক্তি (শয়তানের প্ররোচনা ও সাহায্যের মাধ্যমে) এমন একটি অনুভূতি অর্জন করতে পারে, যখন সে মনে করে যে, সে আর ঈশ্বর এর অস্তিত্ব একই (অর্থাৎ সে ঈশ্বরের অংশ)। তবে এই স্তরে তখনও দ্বৈতবাদ এর অনুভূতি কাজ করে এবং সে জগৎ এর পৃথক অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। আর যখন ব্যক্তি (নিজের অজান্তেই শয়তানের তীব্র প্ররোচনা ও সহায়তায়) এই উপলব্ধি অর্জন করে, যেন সে নিজের আর জগতের মধ্যে কোনো পৃথক অস্তিত্ব বুঝতে পারে না, তখন সেই সর্বোচ্চ স্তরকে বলে নির্বিকল্প সমাধি।
.
ভগবতগীতা বলছে,
"হে পান্ডব, এইভাবে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তুমি আর মোহগ্রস্ত হবে না, যখন জানবে **সমস্ত জীবই আমার বিভিন্ন অংশ এবং তারা সকলেই আমাতে অবস্থিত** এবং তারা সকলেই আমার।"
(ভগবতগীতা, ৪:৩৫)
.
নাস্তিকদের ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করায় তারা এখানে কেবল নির্বিকল্প সমাধি এর মাধ্যমে জগতের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। তবে আস্তিকেরা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে বিধায় হিন্দু দর্শন অনুযায়ী এই এক হয়ে যাওয়ার অর্থ হল, জগতের সমস্ত রকম বন্ধন, আসক্তি, ব্যাধি, মায়া, জন্ম, মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পেয়ে ঈশ্বরের অংশের সাথে এক হয়ে যাওয়া বা মিশে যাওয়া। এরূপ পর্যায়কেই মোক্ষ বা মুক্তি এর সাথে তুলনা করা হয়, যে ধারণাটাকেই বৌদ্ধধর্মে ঘষে মেজে "নির্বাণ" বলা হয়েছে।
.
মূর্তিপূজা বা সাকার উপাসনা উপরিউক্ত আলোচনার মধ্যে দ্বৈতবাদ এর স্তরের আওতায় পড়বে। অর্থাৎ যে ধারণাতে ব্যক্তি উপলব্ধি করছে যে, সে ঈশ্বর হতে পৃথক সত্ত্বা।
.
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, উপরিউক্ত আলোচনায় যে মুক্তি বা মোক্ষলাভের কথা বলা হয়েছে, এটি অর্জন করাই হল হিন্দু দর্শন অনুযায়ী চূড়ান্ত লক্ষ্য। তবে এই চূড়ান্ত স্তরে একবারে যাওয়া যায় না বলে এর পূর্বে কিছু স্তর প্রথমে অতিক্রম করার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে হিন্দু দর্শন এর দাবি অনুযায়ী, যেহেতু মুক্তি লাভের মাধ্যমে জগতের আসক্তি, কামনা ইত্যাদি হতে মুক্ত হওয়া যায়, সেহেতু এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, এই দর্শনের বক্তব্য অনুযায়ী, মুক্তি লাভের পূর্বের নিম্ন স্তরগুলোতে ব্যক্তির মধ্যে থাকে জগতের প্রতি আসক্তি, কামনা-বাসনা। আর এই কামনা-বাসনার মধ্যে ব্যক্তি যখন নিম্নতর স্তরে রয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে সেই স্তরগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপাসনাও (নিন্দনীয় হলেও) ব্যক্তির জন্য সেই পর্যায়গুলিতে অনুমোদিত।
.
মূর্তিপূজা বা সাকার উপাসনা এমনই একটি নিম্নস্তর যখন হিন্দু দর্শন অনুযায়ী ব্যক্তির মধ্যে কামনা বা জগতের প্রতি আসক্তি কাজ করে। আর তাই মূর্তিপূজার স্তর অতিক্রম করার আগ পর্যন্ত সেই স্তরে তাই মূর্তিপূজা অনুমোদিত।
.
ভগবতগীতা বলছে,
.
"যাদের মন জড়-কামনা বাসনা দ্বারা বিকৃত তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয়ে এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে।
.
পরমাত্মারূপে আমি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করি। যখন কেউ দেবতাদের পূজা করতে ইচ্ছা করে আমি তাদের শ্রদ্ধানুসারে সেই সেই দেবতাদের প্রতি ভক্তি বিধান করি।"
(ভগবতগীতা, ৭:২০-২১)
.
"যে যেভাবে আমার প্রতি আত্মসমর্পণ করে, প্রপত্তি স্বীকার করে, আমি তাকে সেইভাবেই পুরষ্কৃত করি। হে পার্থ, সকলেই সর্বতভাবে আমাকে অনুসরণ করে।"
(ভগবতগীতা, ৪:১১)
.
তবে এক্ষেত্রে বৈষ্ণব মতবাদে এই বিষয়টির কিছুটা ব্যক্তিক্রম রয়েছে।
.
কৃষ্ণভক্তির মতবাদ অনুযায়ী, অন্যান্য দেবদেবীর উপাসনা কামনাযুক্ত। কিন্তু কৃষ্ণভক্তি কামনামুক্ত। কেননা বৈষ্ণব ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বৈষ্ণবগণ সকল কাজ কেবল কৃষ্ণের সেবায় সম্পন্ন করে থাকে বিধায় তারা কৃষ্ণভক্তিতে মগ্ন হওয়ার মাধ্যমে সমাধি অর্জন করে থাকে।
.
"..কৃষ্ণ চেতনায় কারও জন্য বস্তুগত ক্রিয়াকলাপ নেই, কারণ সকল কিছুই কৃষ্ণের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। একজন শুদ্ধ ভক্ত সর্বদাই নিমগ্ন থাকে - কখনও সে জপ করে, কখনও কৃষ্ণ সম্পর্কিত বই পড়ে বা শোনে, অথবা কখনও সে প্রসাদ রান্না করে, অথবা কখনও বাজারে যায় কৃষ্ণের জন্য কিছু কিনতে, অথবা কখনও সে মন্দির বা থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করে - যা-ই সে করুক না কেন, এক মুহূর্তও সে অতিবাহিত করে না নিজের কর্মকে কৃষ্ণের প্রতি নিবেদন না করে। এই ক্রিয়াই হল পূর্ণ সমাধি।"
.
[গীতা ১২:২ এর ওপর স্বামী প্রভুপাদের ভাষ্য হতে গৃহীত/উৎস: https://asitis.com/12/2.html]
.
"..For one in such Krsna consciousness there are no material activities because everything is done by Krsna. A pure devotee is constantly engaged - sometimes he chants, sometimes he hears or reads books about Krsna, or sometimes he cooks prasadam or goes to the marketplace to purchase something for Krsna, or sometimes he washes the temple or the dishes - whatever he does, he does not let a single moment pass without devoting his activities to Krsna Such action is in full samadhi."
.
[Swami Prabhupada on Gita 12:2/source - https://asitis.com/12/2.html]
.
.
এক্ষেত্রে যেহেতু, কৃষ্ণভক্তি অনুযায়ী উপাসনা - কামনা ও জগতের আসক্তি মুক্ত - তাই সেক্ষেত্রে কৃষ্ণের রূপের উপাসনা করা কোনো নিম্ন পর্যায়ের উপাসনা নয়। বরং এক্ষেত্রে কৃষ্ণের সাকার উপাসনাকারীরা হল শ্রেষ্ঠ যোগী এবং নিরাকার উপাসনাকারী যোগীরা এর সাপেক্ষে নিম্নতর।
.
ভগবতগীতা বলছে,
.
"অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- হে ভগবান, এই ভাবে নিরন্তর ভক্তিযুক্ত হয়ে যারা সমাহিত চিত্তে তোমার আরাধনা করে এবং যারা ইন্দ্রিয়াতীত অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা করে, তাদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ যোগী?
.
ভগবান বললেন- যিনি আমার সবিশেষ রূপে তার মনকে নিবিষ্ট করেন, অপ্রাকৃত ভক্তিসহকারে নিরন্তর উপাসনা করেন আমার মতে তারাই শ্রেষ্ঠ যোগী।"
(ভগবতগীতা, ১২:১-২)
.
"যারা ভগবানের অব্যক্ত নির্বিশেষ রূপের প্রতি আসক্ত তাদের পক্ষে পরমার্থিক লাভ করা অত্যন্ত কষ্টকর। কারণ অব্যক্তের উপাসনার ফলে দুঃখই লাভ হয়।" (ভগবতগীতা, ১২:৫)
.
.
এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল এই যে, হিন্দু শাস্ত্রে যে সকল স্থানে এক ঈশ্বরের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে পরোক্ষভাবে নিরাকার ঈশ্বর এবং অদ্বৈতবাদকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং যে সকল স্থানে মূর্তিপূজাকে নিন্দা করা হয়েছে, সেখানে মূলত বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনাকে কামনা-বাসনা জনিত নিম্ন পর্যায়ের উপাসনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
.
তাই মুসলিম ভাই-বোনদের নিকট আমার অনুরোধ, দয়া করে হিন্দু দর্শনের সাথে ইসলামের সাদৃশ্য খোঁজা বন্ধ করুন, কারণ এর মাধ্যমে হয়ত আপনি ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি কোনো হিন্দুর সামনে তুলে ধরতে পারছেন, কিন্তু সত্যকে মিথ্যার থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হচ্ছেন না।
.
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকল প্রকার মুশরিকি মত ও পথ থেকে দূরে রাখুন এবং সহিহ ইসলামিক আকিদায় অটল থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
.
وَٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةً لَّا يَخْلُقُونَ شَيْـًٔا وَهُمْ يُخْلَقُونَ وَلَا يَمْلِكُونَ لِأَنفُسِهِمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا وَلَا يَمْلِكُونَ مَوْتًا وَلَا حَيَوٰةً وَلَا نُشُورًا
.
"তারা তাঁর পরিবর্তে কত উপাস্য গ্রহণ করেছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না এবং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং নিজেদের ভালও করতে পারে না, মন্দও করতে পারে না এবং জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনের ও তারা মালিক নয়।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২৫:৩)
.
====================
লেখক: আহমেদ আলি
[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...
Comments
Post a Comment