(নাফসের প্রতারণা হতে এখনই সাবধান হোন)
.
.
"মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী..."[১]
অর্থাৎ, পুরুষের মনস্তত্ত্ব একেবারে সোজা-সাপটা! আর সেটা হল নারীর প্রতি কামনা, যার সঙ্গে মিশে আছে উগ্রতা! আর এই উগ্রময় কামনার পিছনে আপনি যত বেশি ছুটতে থাকবেন, এই দুনিয়ায় তত বেশি আপনি পথভ্রষ্ট হবেন। কারণ "...পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়।"[২]
.
একজন ছেলে, যুবক বা পুরুষ যাই বলা হোক না কেন, প্রায়ই এই ছলনাময় ভোগের পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজের নাফস বা প্রবৃত্তির প্রতারণাকে চিহ্নিত করতে পারে না। শয়তানের প্ররোচনা আর নাফসের ছলনার মধ্যে সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে।
শয়তান হল সেই সত্ত্বা "যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে"[৩]
আর "যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়"[৪] এবং তখন তার নাফস, শয়তানের পরামর্শ একেবারে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করে। ফলে শয়তানি পরামর্শ, নাফসের নেতিবাচক বিলাসিতাকে ব্যক্তির সামনে ইতিবাচকরূপে উপস্থাপন করে এবং ব্যক্তি আপন "প্রবৃত্তিকে নিজের উপাস্যরূপে গ্রহণ করে।"[৫]
.
বিষয়টিকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক।
.
রাস্তায় চলার সময় বা কোনো প্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোনো স্থানে কোনো ছেলে যখন প্রকৃত হিজাব-নিকাববিহীন[৬] কোনো মেয়েকে দেখে, তখন প্রায়ই সেই ছেলের পুরুষতাত্ত্বিক মনোভাবে সেই মুহূর্তে এই চিন্তা আসে যে, 'এই মেয়েটি তো খুব ভালো! আমার তো একে ভালোই লাগছে! ওর প্রতি তো আমার কোনো বাজে চিন্তা নেই, তা ভালভাবে দেখি তো মেয়েটা কেমন! সে আমার ভাল বন্ধু হতে পারে। এতে খারাপের কী আছে!'
.
কোনো দ্বীনি ভাইকে ছোট করছি না; কিন্তু পুরুষ হিসেবে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে, এরূপ চিন্তা আপনার মনে কখনই আসে না! বরং আমার চিন্তালব্ধ বিশ্লেষণ বলে যে, এই ধরণের চিন্তাই সর্বপ্রথম আপনার মনে আসা শুরু করে, যখন হিজাব-নিকাববিহীন কোনো অচেনা মেয়ে আপনার সামনে এসে উপস্থিত হয় আর আপনার দৃষ্টি নিজের অজান্তেই তার ওপর পতিত হয়!
.
এবার লক্ষ্য করুন। আপনি হয়ত ওই মেয়েকে চেনেনই না, অথচ তারপরও কেন আপনার তাকে দেখেই ভালো লাগছে? তার সাথে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে করছে? তার দিকে তাকিয়ে থাকার ইচ্ছেটাকে পবিত্র বলে মনে হচ্ছে?
.
এর কারণ হল এটাই যে, এটি আপনার নাফসের প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়!
.
প্রথম দৃষ্টিতেই প্রকৃত হিজাব-নিকাবহীন কোনো নারীর প্রতি পুরুষের কামনা হঠাৎ করেই জাগ্রত হয়। এটা হল পুরুষের মনস্তত্ত্বের সেই বাস্তব উগ্র রূপ যা তার পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া (চোখ - দৃষ্টি, কান - শ্রবণ, নাক - গন্ধ, জিহ্বা - স্বাদ, ত্বক - স্পর্শ) এর প্রতি আকর্ষণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলস্বরূপ, ব্যক্তির মানসিক চিন্তাধারার ওপর এরূপ প্রভাব ব্যক্তিকে সেই নারীর প্রতি মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে!
.
ঠিক সেই মুহুর্তেই শয়তান মানুষের অন্তরে এই প্ররোচনা দিতে থাকে যে, 'মেয়েটি দেখো কত ভাল! সে তোমার ভাল বন্ধু! সে তো তোমার বোনেরই মত! তার প্রতি তো তোমার কোনো বাজে চিন্তা নেই; তাহলে তাকে দেখতে কীসের পাপ! তার কাছে যাও, কথা বলো। নিজের মনের জড়তা কাটিয়ে ফেল!' ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফলস্বরূপ হারাম পোশাকে সজ্জিত 'অনাবৃত আওরাহ'-বিশিষ্ট নারীকে পুরুষ-চিত্তে উত্তম বলে মনে হতে শুরু করে। আর এটি তখনই মনে হতে থাকে, যখন ব্যক্তির নাফস এরূপ হারাম পরামর্শকে সাদরে গ্রহণ করে সেই হারাম বিষয়কে হালাল মনে করে তার পিছনে ছুটতে প্রস্তুত হয়ে যায়!
.
এভাবেই শয়তান কোনো পুরুষের সামনে আওরাহ খোলা গায়েরে মাহারাম নারীকে ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরে, যার ফলে সেই নারী তার নিকট আরও অধিক আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
.
একারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
.
"রমণী মাত্রই আবরণীয় (বিষয়), যখন সে বের হয় তখন শায়ত্বন তাকে সুশোভিত করে তোলে বা শায়ত্বন হাত আড় করে তার প্রতি তাকায়।"[৭]
.
এই মুহুর্তে ব্যক্তি যদি কামনার পিছে ছুটতে থাকে এবং হারাম উপভোগে নিজেকে নিয়োজিত করে, তবে সন্তুষ্টি লাভের পরিবর্তে সে আরও অধিক হারে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠবে! ফলে নাফসের পশ্চাদে ছোটার দরুণ ক্রমাগত তার প্রকৃত বিচার-বুদ্ধি লোপ পেতে শুরু করবে এবং সে পশুর থেকেও অধম পর্যায়ে ধাবিত হবে!
.
মহান আল্লাহ ঘোষণা করছেন,
.
"তুমি কি দেখ না তাকে, যে তার কামনা বাসনাকে উপাস্য রূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে?
তুমি কি মনে করো যে, তাদের অধিকাংশ শোনে ও বোঝে? তারা তো পশুরই মত; বরং তারা আরও অধম।"[৮]
.
আপনি হয়ত ভাবতে পারেন যে, এখানে আপনার দোষটা কোথায় - আপনি তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণই করতে পারছেন না!
উত্তরে আমি বলব যে, আপনি আবারও নাফসের প্রতারণায় প্রতারিত হচ্ছেন!
কারণ আল্লাহ তাআলা আপনাকে যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, আপনি তার অপপ্রয়োগ করে ফলাফল নিজেই ভোগ করছেন এবং শেষে গিয়ে দোষটা আবার তাঁর ওপরই চাপানোর চেষ্টা করছেন, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন! (নাউজুবিল্লাহ)
.
প্রথমত, এক বিশেষ পর্যায়ে গিয়ে আপনার নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে না। যেমন ধরুন, আপনি কোনো মেয়ের সাথে শারীরিক ক্রিয়ার আনন্দে রত, ঠিক সেই মুহুর্তে আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না! কিন্তু এই কাজ করার আগে আপনি তো সেই হারাম পথটি নিজের ইচ্ছাতেই বেছে নিয়েছেন! তাই নয় কী! সেই সময় তো আপনার এই হারাম পথ থেকে সরে আসার সুযোগ ছিল! কিন্তু আপনি কি সরে এসেছিলেন?
.
যখন প্রথম বার আপনি সেই মেয়ের দিকে ভুলক্রমে তাকিয়ে ফেলেছিলেন আর দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে তাকিয়েই ছিলেন, তখন আপনার কি আল্লাহ তাআলার এই হুকুমটা মানার প্রয়োজনীয়তা ছিল না - যেখানে আল্লাহ তাআলা আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছেন, "মুমিনদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের যৌন অঙ্গকে সাবধানে সংযত রাখে.."???[৯]
.
কোনো গায়েরে মাহারাম রমণীর আহবানে সাড়া দিয়ে অভিসারে যাওয়ার আগে আপনার মনে কি ইউসুফ (আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সেই শিক্ষাকে অনুসরণের ইচ্ছা এসেছিল - যখন তিনি ব্যভিচারের আহবান প্রত্যাখান করে মিসরের রমণীকে বলেছিলেন, "আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি"???[১০]
.
গায়েরে মাহরামের হাত ধরে হাঁটার সময়, একে অপরের কাছে আসার সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এই সতর্কবাণীর প্রতি আপনার ভ্রূক্ষেপ ছিল না - যখন তিনি বলেছিলেন, ‘‘কোন ব্যক্তির মাথায় লৌহ সূঁচ দ্বারা খোঁচা যাওয়া ভালো, তবুও যে নারী তার জন্য অবৈধ তাকে স্পর্শ করা ভালো নয়’’???[১১]
.
তাহলে ভাই দোষটা আসলে কার? যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি হারাম পথটিই বেছে নেয়, তখন তার জন্য সে নিজেই দায়ী হবে; আর তাই এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ পালন করে চলা যতই তা আপনার কাছে অস্বস্তিকর মনে হোক না কেন!
.
আমাদের জেনে রাখা উচিৎ যে, হারাম বিষয়ের উপভোগ হতে সন্তুষ্টি আসে না, বরং প্রাপ্তি ঘটে কেবল অসন্তোষ ও তীব্র যন্ত্রণার, যার ফল দুনিয়ায় যেমন ভোগ করতে হয়, তেমনি আখিরাতেও (আল্লাহ না চাইলে) বাঁচা যায় না তা থেকে!
.
সন্তুষ্টি কেবল তখনই আসে, যখন আপনার হৃদয় আল্লাহর স্মরণে নত হয়েছে, কারণ একমাত্র "আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।"[১২]
.
তাই হারাম পথে পা বাড়িয়ে হারাম কার্যে লিপ্ত হলেও সত্য অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যক্তির উচিৎ তওবা করে আল্লাহর নিকট ফিরে আসা; কারণ আল্লাহ বলেন, "হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।"[১৩]
.
তাই এখনই সময়, আসুন নাফসের প্রতারণা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা হারামের পরিবর্তে হালাল পথে আপন পৌরষত্বের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ত্যাগ, সংযম ও আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হই এবং পরিপূর্ণ রূপে আল্লাহ তাআলার স্মরণে নিজেদেরকে আত্মনিবেদন করে হারামের বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রামে রত হই।
.
মহান আল্লাহ ঘোষণা করছেন:
.
يَٰٓأَيَّتُهَا ٱلنَّفْسُ ٱلْمُطْمَئِنَّةُ
ٱرْجِعِىٓ إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً
فَٱدْخُلِى فِى عِبَٰدِى
وَٱدْخُلِى جَنَّتِى
.
"হে প্রশান্ত চিত্ত!
তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে; অতঃপর তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।"[১৪]
.
____________________
তথ্যসূত্র:
[১] আল-কোরআন, ৩:১৪
[২] আল-কোরআন, ৫৭:২০
[৩] আল-কোরআন, ১১৪:৫
[৪] আল-কোরআন, ৪:১১৯
[৫] আল-কোরআন, ২৫:৪৩
[৬] টাইট জিন্স প্যান্ট, পুরুষালি শার্ট পরে মাথায় স্কার্ফ এর মত রুমাল টাইপের পোশাক, আঁটাসাঁটা অন্য ধরণের কোনো পোশাক, সেজেগুজে মেকাপ, পারফিউম দিয়ে, হিজাবের স্টাইলে আকর্ষণীয় ধরণের পোশাক ইত্যাদি আজ হিজাবের নামে তৈরি ও পরিধান করে ফিতনাযুক্ত ফ্যাশান চালু করা হয়েছে; যেগুলো নকল হিজাব ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী পরিহিত প্রকৃত হিজাব-নিকাব এর বৈশিষ্ট্যই হল, তা আকর্ষণ বৃদ্ধি করে না, বরং অবাঞ্ছিত ফিতনাযুক্ত উগ্র আকর্ষণ প্রতিরোধ করে।
[৭] মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ৩১০৯, তিরমিযী ১১৭৩, ইরওয়া ২৭৩, সহীহ আল জামি‘ ৬৬৯০। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
উৎস - http://www.hadithbd.com/share.php?hid=68436
[৮] আল-কোরআন, ২৫:৪৩-৪৪
[৯] আল-কোরআন, ২৪:৩০
[১০] আল-কোরআন, ১২:২৩
[১১] ত্বাবারানী ১৬৮৮০-১৬৮৮১, সিঃ সহীহাহ ২২৬
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
উৎস - http://www.hadithbd.com/share.php?hid=66410
[১২] আল-কোরআন, ১৩:২৮
[১৩] আল-কোরআন, ৩৯:৫৩
[১৪] আল-কোরআন, ৮৯:২৭-৩০
========================
.
**কোনোরূপ ভুলত্রুটির জন্য আল্লাহ তাআলা মার্জনা করুন এবং আমাদের সকলকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন।**
- আহমেদ আলি
[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...
Comments
Post a Comment