Skip to main content

কর্মযোগ বনাম ইসলাম


"তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি" - শ্যামাসংগীতের এই লাইনটা হয়ত অনেকেই শুনে থাকবেন, কিন্তু কখনও একবারও ভেবে দেখেছেন, হিন্দুরা এটা দিয়ে আসলে কী বুঝাতে চাচ্ছে?
এর মমার্থ বিশদে বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হবে, তাই কেবল প্রধান অংশটুকু সম্পর্কে বলার চেষ্টা করছি।
.
এই বিষয়টি বুঝতে হলে আগে আপনাকে আরও কিছু জিনিস ক্লিয়ার করতে হবে। যে বিষয়টি এখানে মুখ্য, সেটা হল, হিন্দু দর্শন অনুযায়ী, আপনার ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন নয়। প্রকৃতি আপনাকে দিয়ে জোর করে কাজ করিয়ে নেয়, আর আপনি ভাবেন যে, আপনি আসলে কাজের কর্তা। এরূপ কাজকে বলা হয় "স্বকাম কর্ম" যখন ব্যক্তি মনে করে যে, সে কাজ করছে আর কাজের দায়ভার তার নিজের। কিন্তু হিন্দু দর্শন বলছে যে, আসলে ব্যক্তির নিজের কোনো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই, এটা আসলে বিভ্রম। আর তাই প্রকৃতি তাকে দিয়ে জোর করে কাজ করিয়ে নেয় এবং প্রকৃতির তিনটি গুণের মধ্যে যে কোনো একটি ব্যক্তির মধ্যে কাজ করতে পারে - সেই গুণ তিনটি হল "সত্ত্বঃ", "রজঃ" এবং "তমঃ"। এর একটা বিস্তারিত বিবরণ পাবেন ভগবতগীতাতে। তবে বোঝার সুবিধার্থে আমি কয়েকটি রেফারেন্স এর উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
.
"হে মহাবাহো, জড় প্রকৃতি থেকে সত্ত্বঃ, রজঃ ,তমঃ এই তিনটি গুণের প্রকাশ হয়। জীব যখন জড়া প্রকৃতির সংর্স্পশে আসে তখন সে তিনটি গুণের দ্বারা আবদ্ধ হয়।" (গীতা, ১৪:৫)
.
"হে নিষ্পাপ, এই তিনটি গুণের মধ্যে সত্ত্ব গুণ অপেক্ষাকৃত নির্মল, প্রকাশক এবং পাপশুন্য। এই সত্ত্ব গুণ 'আমি সুখী' এই প্রকার সুখাশক্তি এবং 'আমি জ্ঞানী' এই প্রকার জ্ঞানশক্তি দ্বারা আমাকে আবদ্ধ করে।" (গীতা, ১৪:৬)
.
"হে কৌন্তেয়, অন্তহীন কামনা বাসনা থেকে রজগুণের উৎপত্তি হয় এবং রজগুণই জীবকে সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করে।" (গীতা, ১৪:৭)
.
"হে ভারত, তমঃগুণ জীবের ভ্রান্তি উৎপাদন করে। প্রমোদ, আলস্য ও নিদ্রার দ্বারা তমঃগুণ জীবকে আবদ্ধ করে।" (গীতা, ১৪:৮)
.
এখানে এভাবে কিছুটা বলা যায়, যখন কারও জ্ঞান বৃদ্ধি পায় ও সে উত্তম অভ্যাস ও স্বভাবের হয়ে ওঠে এবং সে মনে করে যে, তার যা আছে তাতেই সে সন্তুষ্ট, তখন বলা যায়, তার মধ্যে সত্ত্ব গুণ প্রকাশিত হচ্ছে।
.
যখন ব্যক্তির এই অবস্থার কিছুটা অবনতি ঘটে এবং তার মধ্যে আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা বৃদ্ধি পায়; ফলে দুনিয়ার প্রতি তার আসক্তিও বাড়তে থাকে, তখন সে রজঃ গুণের অধিকারী হয়ে ওঠে।
.
আর ব্যক্তির যখন এই অবস্থারও আরও অবনতি ঘটে এবং সে ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত হয়ে ওঠে এবং পশুর মত জীবনচারণ করতে থাকে, তখন তার মধ্যে তমঃ গুণ প্রকাশ পায়।
.
.
তবে এসবের মধ্যেও একটা ঘোরতর সমস্যা আছে যেটা একজন মুসলিম সহজে ধরতে পারে না, সেটা হল হিন্দু দর্শন এই সকল কিছু বলার পর শেষ পর্যায়ে গিয়ে মন্তব্য করছে যে, জীবের মূল লক্ষ্য হল প্রকৃতির এই গুণগুলোকে অতিক্রম করা:
.
"দেহধারী জীব যখন প্রকৃতির তিন গুণ অতিক্রম করে জন্ম, জরারূপ, দুঃখ বিমুক্ত হন, তখন তিনি ইহজীবনেই অমৃত তত্ত্ব আস্বাদন করেন।" (গীতা, ১৪:২০)
.
ব্যাপারটা আরও একটু পরিষ্কার করা যাক। হিন্দু দর্শন অনুযায়ী, সব কিছু ঈশ্বরের অংশ, কিন্তু ইসলাম ঘোষণা করছে যে, এটা মিথ্যা দাবি, কারণ আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজ অংশ হতে নয়, বরং শুন্য হতে সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন (এই বিষয়য়টি সম্পর্কে পড়ুন এখানে: হিন্দুধর্মের অস্পষ্ট একেশ্বরবাদ )।
.
তাহলে এখানে মূল কথাটি হল, জীব যে ঈশ্বরের অংশ, এটা অন্তর থেকে অনুভব করতে না পারাকেই বলে "মায়া"। আর জীবের মধ্যে যতক্ষণ এই মায়া কাজ করে, ততক্ষণ সে মনে করে যে, সে-ই কাজ করে যাচ্ছে, যেখানে তার কোনো ইচ্ছাশক্তি নেই, বরং প্রকৃতি তাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে। তাই যখন সে এই বিভ্রমের মধ্যে আছে যে, সে-ই কাজ করছে, তখন সে পাপ বা পুণ্য এর আশা করছে। ফলে যে পাপ বা পুণ্য সে করছে, তা হচ্ছে তার সেই তিনটি গুণের প্রভাবে। তাই হিন্দু শাস্ত্র এখানে মন্তব্য করছে যে, এই তিনটি গুণ এবং পাপ-পুণ্য এর আশা ছেড়ে দিয়ে এমনভাবে কাজ করতে যখন ব্যক্তি মনে করবে, 'আমি কাজ করি না, ঈশ্বর আমায় দিয়ে কাজ করাচ্ছেন, আর তাই কেবল ঈশ্বরের কর্ম তাঁর সন্তুষ্টিতে সম্পাদন করে দেওয়ায় দায়িত্ব। সেই কাজ আর তার ফলাফলের ওপর আমার কোনো অধিকার নেই।'
এক কথায়, এরূপ কাজকে বলে "আকাঙ্ক্ষাবিহীন কর্ম" যা "নিষ্কাম কর্ম" নামেও পরিচিত। এর মাধ্যমে ব্যক্তি এক জন্মে না হলেও ধাপে ধাপে বিভিন্ন জন্মের মাধ্যমে ক্রমাগত নিজের অবস্থা আর স্বভাবের উন্নতির মাধ্যমে এক পর্যায়ে নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে পাপ-পুণ্যের চিন্তা অতিক্রম করে কাজের ফলাফলের আকাঙ্ক্ষামুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে মিশে গিয়ে জড়জগতের বন্ধন হতে মুক্তি লাভ করবে।
.
ঠিক এখানেই ইসলাম সূক্ষ্মভাবে এই পথভ্রষ্টতার উত্তর দিয়েছে। যখন আমি প্রথম কোরআন এর বাণী শুনতে শুরু করলাম, তখন এই সকল কনসেপ্ট এর সরাসরি উত্তর শুনতে পেয়ে আমার গা শিউরে উঠতে শুরু করল। বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এই ভ্রষ্ট ধারণার জবাব দিয়েছেন সূক্ষ্মভাবে। তবে আমার মতে এর মূল জবাবটি আছে যে সকল আয়াতে আছে, তার মধ্যে দুটি আয়াত এরকম:
.
أَوَلَا يَذْكُرُ ٱلْإِنسَٰنُ أَنَّا خَلَقْنَٰهُ مِن قَبْلُ وَلَمْ يَكُ شَيْـًٔا
.
"মানুষ কি স্মরণ করে না যে, আমি পূর্বে তাকে (শুন্য থেকে) সৃষ্টি করেছি আর সে তখন কিছুই ছিল না।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ১৯:৬৭)
.
.
بَدِيعُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِۖ وَإِذَا قَضَىٰٓ أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ
.
"আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃজনকারী, যখন কোন কাজ করতে মনস্থ করেন, তখন তার জন্য শুধু বলেন, 'হয়ে যাও', তক্ষুনি তা হয়ে যায়।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২:১১৭)
.
এর অর্থ এটাই যে, আল্লাহ কোনো কিছু তাঁর অংশ থেকে তৈরি করেন নি বিধায় এটা ভাবা যেমন ঠিক না যে, আমরা তাঁর অংশ, তেমনি এটাও সঠিক নয় যে, আমাদের কোনো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই এবং আল্লাহ আমাদের দিয়ে জোর করে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন।
.
তাই ইসলামের সংশোধনী ঘোষণা হল এটাই যে, যেহেতু স্রষ্টা ও সৃষ্টি পৃথক, তাই "মায়া" বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। মানুষ প্রকৃতির গুণের দ্বারা চালিত হয় ঠিকই, কিন্তু তার পাশাপাশি আরেকটি জিনিস এখানে ব্যক্তির মধ্যে কাজ করে, আর তা হল আল্লাহ প্রদত্ত তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। ফলে সে নিজের ইচ্ছাতেই বেছে নিতে পারে সে প্রকৃতির কোন ধরণের গুণের অনুসরণ করবে। তবে এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, এই গুণকে অতিক্রম করা জীবনের উদ্দেশ্য নয়। বরং আল্লাহ তায়ালার নিকট আত্মসমর্পণই একমাত্র লক্ষ্য। কারণ চূড়ান্ত গন্তব্য ঈশ্বরের অংশের সাথে মিশে যাওয়া নয়, বরং পৃথক সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত জান্নাত বা জাহান্নামের কোনো একটিতে নিজের কর্ম অনুসারে গমন করা।
.
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকল প্রকার পথভ্রষ্টতা হতে মুক্ত করে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করুন। আমিন।
.
.
.
আহমেদ আলি সিরিজ/কর্মযোগ বনাম ইসলাম

Comments

Popular posts from this blog

মানহাজ ও মাযাহাব নিয়ে যত দ্বন্দ্বের জবাব....

[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...

কৃষ্ণ কি আল্লাহর নবী ছিল?

এই প্রশ্নটা আমাকেও করা হয়েছে সম্ভবত কয়েকবার। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরটা বড়ই জটিল। কারণ এর কোনো যথাযথ উত্তর আমাদের জানা নেই। যদি কৃষ্ণের গোপীদের সাথে লীলার কাজকে সত্য বলে...

Permission of Adultery and Fornication in Hinduism - Remaining Part

Read the previous part here: http:// uniqueislamblog.blogspot.com /2017/11/ permission-of-adultery-and-fornication.html ?m=1 => Condemning physical relationship outside marriage: Generally physical relationship outside marriage is condemned in Hindu Philosophy. Bhagabat Gita says, "There are three gates leading to this hell-**lust**, anger, and greed. Every sane man should give these up, for they lead to the degradation of the soul." (Bhagabat Gita, 16:21) ['Bhagabat Gita As It Is' by His Divine Grace A.C. Bhaktivedanta Swami Prabhupada] This verse indicates that lust or desire outside marriage can lead one to hell if it is not maintained properly. It is further mentioned in Yajur Veda, "O God, **cast aside a lover**, **who cohabits with another's wife** ; **a paramour having illicit connection with a domestic woman** ; **an unmarried elder brother suffering from the pangs of passion** ; younger brother who has married before his elder to ...