Skip to main content

আল্লাহ তাআলা কীভাবে এলেন? (পর্ব ১)


মহান আল্লাহ কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করছেন,

"তিনিই তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন। এ কিতাবে দুই ধরনের আয়াত আছেঃ এক হচ্ছে, মুহকামাত, যেগুলো কিতাবের আসল বুনিয়াদ এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, মুতাশাবিহাত। যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সবসময় মুতাশাবিহাতের পিছনে লেগে থাকে এবং তার অর্থ করার চেষ্টা করে থাকে। অথচ সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ‌ ছাড়া আর কেউ জানে না। বিপরীত পক্ষে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা বলেঃ “আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের রবের পক্ষ থেকেই এসেছে”। আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবান লোকেরাই কোন বিষয় থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।"
(আল-কোরআন, ৩:৭)
.
অর্থাৎ কোরআন এর মুতাশাবিহাত আয়াতের অর্থকে আল্লাহর রহমতে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান ও উপলব্ধি দিয়ে ততটুকুই বুঝতে পারব, যতটুকু আমাদের ক্ষমতায় রয়েছে আর যতটুকু আল্লাহ তাআলা আমাদের অনুমতি দেবেন। আমাদের ক্ষমতার বাইরে যা আমাদের সীমার উর্ধ্বে, সেই উপলব্ধি আমাদের লাভ করা সম্ভব নয়।
.
এখন এই ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে গেল আপনার বোঝার জন্য। তাই আমি কিছু উদাহরণে আগে আসি। ধরুন বলা হল, আপনি কোথায় থাকেন? বললেন বাংলাদেশে। এখন আমি কীভাবে বুঝছি আপনার অবস্থান? এইজন্য যে, বাংলাদেশের অবস্থানকে আমি চারপাশের দেশের সাপেক্ষে, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমার সাপেক্ষে বিচার করে তারপর তুলনা করে অবস্থান নির্ণয় করছি। যদি আমি চারপাশের কোনো কিছুর সাথেই তুলনা করতে না পারতাম, তবে বাংলাদেশ যে কোথায়, এটা বোঝা কখনই সম্ভব হত না। একইভাবে পৃথিবী কোথায় এটা বুঝছি সূর্য বা অন্য কোনো মহাজাগতিক বিষয়ের সাথে তুলনা করে বা তার সাপেক্ষে। এই তুলনা ছাড়া কিছুই আমরা বুঝতে পারি না। এখানে কোরআন বলছে যে, "তাঁর সমতুল্য কিছুই নেই" (আল-কোরআন, ১১২:৪), অর্থাৎ তুলনা করে আমরা আল্লাহকে বুঝতে পারব না। আপনি নিজেই বললেন যে, আল্লাহ স্থান, সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন। তাই আমরা সৃষ্টিকে বুঝতে তুলনা করছি, কিন্তু আল্লাহ এমন আপেক্ষিকতা এবং তুলনার উর্ধ্বে। যেমনভাবে একজন বই লেখককে বইয়ের মধ্যে থাকা লেখা, পৃষ্ঠা দিয়ে তুলনা করে বোঝা যায় না, তেমনিভাবে সৃষ্টির মধ্যে থাকা আপেক্ষিকতা আর পারস্পরিক তুলনা দিয়েও আল্লাহকে বোঝা যায় না। একারণে আমাদের প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি হবে এটাই যে, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া তা যেমনই হোক না কেন এবং নিজের চিন্তাতে যে তুলনামূলক প্রশ্ন আসছে, এটা দিয়ে আল্লাহকে বুঝতে না যাওয়া। কেননা আমাদের চিন্তা তুলনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর আল্লাহ তাআলার সমতুল্য কিছুই নেই।
.
.
এখন যখন আপনি মেনে নিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বকে আপনার মস্তিষ্কের তুলনামূলক প্রশ্ন দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন না। তখন আপনি এখানে আপনার প্রশ্নের উত্তরকে নিয়ে যুক্তি দিয়ে কেবল কিছুটা উপলব্ধিতে যেতে পারেন, তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই যুক্তিও যেন আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের থেকে উর্ধ্বে, সেটা আপনি না ভাবেন, আমাদের এটা মেনে নিতে হবে যে, আমরা সীমিত ক্ষমতার সৃষ্টি যাদের চিন্তার ক্ষমতার একটি সীমা রয়েছে।
এবার যখন বলা হবে, আল্লাহ তাআলা কীভাবে এলেন, তখন এটাকে দুইভাবে আমরা ভাবতে পারি।
.
প্রথমে এভাবে দেখুন - যদি আল্লাহ তাআলা কীভাবে এলেন বলা হয়, এর অর্থ আপনি বুঝাতে চাইছেন যে, আল্লাহ তাআলাও সৃষ্টি হয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)। এখন যদি আল্লাহ তাআলাও সৃষ্টি হন, তাহলে ধরলাম প্রথম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলাকে সৃষ্টি করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। তাহলে একই যুক্তি অনুযায়ী, দ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা প্রথম সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি করবেন। এভাবে তৃতীয় সৃষ্টিকর্তা, চতুর্থ সৃষ্টিকর্তা, পঞ্চম সৃষ্টিকর্তা.... চলতেই থাকবে এবং এটা শেষই হবে না। অর্থাৎ যদি সৃষ্টিকর্তার সংখ্যা শেষ না হয়, এর অর্থ হল প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা যে কে, সেটা আসলে নির্ধারণ করাও সম্ভব না, কারণ প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা কে, এটা বলার পরই আবার সেই সৃষ্টিকর্তার আরও একজন সৃষ্টিকর্তা চলে আসবে। ফলে সৃষ্টিকর্তাই আসলে error হয়ে যাবে, ফলে এই জগতটাই error হয়ে যাবে। এটা যদি বলা হয় যে, যদি ধরে নিই যে, সৃষ্টিকর্তাই নেই, তাহলে আর error হবে না, সেক্ষেত্রে অন্য একটি error চলে আসবে। খেয়াল করুন, প্রত্যেকটি কাজেরই একটি যুক্তিযুক্ত কারণ থাকে। আমি গ্লাস হাতে নিলাম, পানি ঢেলে মুখের কাছে নিয়ে এলাম, কেন? কারণ আমি পানি খাব তাই। আমি কাগজ নিয়ে হাতে কলম ধরলাম, কেন? কারণ আমি কিছু লিখব তাই। একইভাবে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, কেন? কারণ মহাকর্ষ বল, কেন্দ্রমুখী বল ইত্যাদি। একইভাবে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটেছে, কারণ কী? বিগ ব্যাং। বিগ ব্যাং এর কারণ কী? সুপার এ্যাটম। এই সুপার বা যাবতীয় সকল সৃষ্টির কারণ কী? নাস্তিকরা বলে এর কোনো কারণ নেই, এটা by chance চলে এসেছে, কিন্তু এটা যুক্তির বিরুদ্ধে যায়। তাই আস্তিকীয় যুক্তিতে এর উত্তর হল এই সৃষ্টির কারণ হলেন সৃষ্টিকর্তা। এখন যখন আমরা সৃষ্টিকর্তার উৎপত্তি নির্ণয় করতে যাচ্ছিলাম, তখন দেখছিলাম যে, সৃষ্টিকর্তার উৎপত্তি বললে, প্রথম সৃষ্টিকর্তা, দ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা এবং এভাবে চলতেই থাকবে, আর শেষ হবে না, ফলে এই জগতটাই অর্থহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা দেখছি যে, এই জগতটা সত্য। তাই অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তাকে নির্দিষ্ট করতে হবে। আর এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি সব সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিয়ে কেবল "সৃষ্টিকর্তা" তেই থেমে যাব, কেননা যদি আমরা শুধু সৃষ্টিকর্তাতেই থামি, তবেই একমাত্র জগতটাকে সত্য হিসেবে বাস্তবায়ন করতে পারব। আর যদি প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি সৃষ্টিকর্তার সংখ্যা বাড়াতেই থাকি, তাহলে আর চূড়ান্ত সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাব না। একারণে যুক্তি দিয়ে এটাই সঠিক বলে বোঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলাই হলেন চূড়ান্ত সৃষ্টিকর্তা যার কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই এবং তিনি সৃষ্টিহীন এবং তাঁর আদি ও অন্ত নেই।
.
.
এবার দ্বিতীয় পদ্ধতিতে দেখি চলুন। আমরা দেখেছি যে, প্রতিটি কাজেরই একটা কারণ ছিল। এখন এই হিসাবে সৃষ্টির কারণ হলেন সৃষ্টিকর্তা। এখন যখন পালটা প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, তাহলে সৃষ্টিকর্তার কারণটা কী? অর্থাৎ তাঁর উৎপত্তির কারণটা কী - সেখানে একটা বিষয় খেয়াল করুন, আপনি এই প্রশ্ন যখন করছেন, এর অর্থ আপনি মেনে নিলেন যে, এই জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা আছে, এবার এই সৃষ্টিকর্তার ওপর আপনি প্রশ্ন করছেন। এবার আপনি খেয়াল করুন যে, আমরা দেখেছিলাম, সৃষ্টির মধ্যে আপেক্ষিকতা আছে। আপনি যখন সময় হিসাব করছেন, তখন সময়কে মাপছেন আপেক্ষিকতার মধ্যে। অর্থাৎ সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীর ঘূর্ণনকে তুলনা করে, রাত দিন এর হিসাব করে ইত্যাদির মাধ্যমে সময় হিসাব করছেন। এর অর্থ হল, যদি কোনো গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদির সাপেক্ষে তুলনা করার বা অন্য কোনো কিছুর সাথে তুলনা করার কোনো ব্যবস্থাই না থাকত, তবে আপেক্ষিকতার মধ্যে সময়ের হিসাব সম্ভব হত না। এটাই সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য যে, স্থান, সময় এগুলো সবই সৃষ্টি যা হিসাব করা হয় একটার সাপেক্ষে আরেকটা। আর এগুলোর হিসাব শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং এর পর থেকে। বিগ ব্যাং টার্ম নিয়ে অনেকে আপত্তি করেন। তাই শুধুই যদি বলি যে, এই হিসাব শুরু হয়েছে সৃষ্টির পর থেকে, তাহলে এটা বোঝা যায় যে, সৃষ্টির আগে আপেক্ষিকতাও ছিল না, সময়ের হিসাবও ছিল না। অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে কোনো আদি-অন্ত অর্থাৎ starting point - ending point বলে কিছু ছিল না। এজন্য যদি সৃষ্টির পূর্বে কিছু থেকে থাকে, তবে তারও আদি ও অন্ত থাকবে না, মানে সেটা হবে without beginning - without end. আর যেহেতু আল্লাহ তাআলাই সমগ্র সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা, তাই যুক্তি অনুযায়ী, আল্লাহ তাআলারও আদি নেই, অন্ত নেই, অর্থাৎ without beginning, without end. তাই প্রকৃত যুক্তি অনুযায়ী বলা যায়, আল্লাহ তাআলার উৎপত্তি সম্ভব নয়, এটা যুক্তি বিরুদ্ধ বা অযৌক্তিক, তিনি সব সময়ই ছিলেন, তাঁর শুরু ও শেষ নির্ণয় করার চেষ্টা করা আমাদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই না। আল্লাহই ভাল জানেন।
.
ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلْحَىُّ ٱلْقَيُّومُ
.
"আল্লাহ ছাড়া কোনই ইলাহ (উপাস্য) নেই, তিনি চিরঞ্জীব ও নিত্য বিরাজমান।
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ৩:২)
=========================
#আহমেদ_আলি

Comments

Popular posts from this blog

মানহাজ ও মাযাহাব নিয়ে যত দ্বন্দ্বের জবাব....

[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...

কৃষ্ণ কি আল্লাহর নবী ছিল?

এই প্রশ্নটা আমাকেও করা হয়েছে সম্ভবত কয়েকবার। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরটা বড়ই জটিল। কারণ এর কোনো যথাযথ উত্তর আমাদের জানা নেই। যদি কৃষ্ণের গোপীদের সাথে লীলার কাজকে সত্য বলে...

ভগবতগীতার বর্ণভেদ নিয়ে ভক্তদের ভণ্ডামির জবাব

============================ চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ৷ তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্৷৷১৩ অর্থ:  "প্রকৃতির তিনটি গুণ এবং কর্ম অনুসারে আমি মনুষ্য সমাজে চারটি বর্ণ...