কেউ কেউ আমাকে হিন্দুদের এজেন্ট মনে করছেন। সেক্ষেত্রে আপনি যেটা খুশি ভাবতে পারেন। আমি কেবল সত্যটা বলার চেষ্টা করছি। হিন্দু দর্শনের সঙ্গে ইসলামের পার্থক্যটা ঠিক কোথায়, এটা না জানলে সত্য ও মিথ্যাকে পার্থক্য করা খুবই কঠিন।
.
অনেকে হিন্দু ধর্মে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ - এটা দেখাতে গিয়ে যজুর্বেদের এই রেফারেন্স এর উদ্ধৃতি প্রায়ই দিয়ে থাকেন:
.
"তাঁর কোনো প্রতিমূর্তি নেই।"
(শুক্লা যজুর্বেদ, ৩২:৩)
.
এরপর আল-কোরআন ১১২:৪ আয়াতের রেফারেন্স দেন।
.
وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌۢ
.
"আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।”
(আল-কোরআন, ১১২:৪)
.
.
যদি আপনি দাওয়াহ দিতেই চান, আপনার কি এই সাদৃশ্যের ব্যাপারটা প্রসঙ্গ আর ব্যাখ্যা সহ জানা উচিৎ না? অবশ্যই।
.
এবার তাহলে বলুন, আল-কোরআন এর উপরের আয়াতে "তাঁর" বলতে কার কথা বলা হয়েছে? নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলার কথা, যিনি একমাত্র সত্য সৃষ্টিকর্তা। তাই নয় কি? আশা করি, সকলেই আমার সাথে একমত হবেন।
.
এবার আমায় বলুন যে, শুক্লা যজুর্বেদ, ৩২:৩ রেফারেন্সে "তাঁর" বলতে কার কথা বলা হয়েছে? এবারও হয়ত বলবেন, সৃষ্টিকর্তার। আমি বলব, তাহলে এটা কি আপনি নিশ্চিত যে, সেখানে এক সত্য সৃষ্টিকর্তার কথাই বলা হয়েছে? চলুন, ব্যাপারটা আরেকটু দেখি।
.
এখানে শুক্লা যজুর্বেদ, ৩২:৩ রেফারেন্সের ঠিক আগে চলুন ৩২:২ রেফারেন্সটা দেখি। আমি গ্রিফিথ এর অনুবাদ ব্যবহার করছি। গ্রিফিথ হিন্দুও না, মুসলিমও না। তাই তার অনুবাদ নিরপেক্ষ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আমি রেফারেন্স এর সাথে ওয়েবসাইটের লিঙ্কও দিয়ে দিচ্ছি যাতে কেউ যাচাই করে নিতে পারেন।
.
শুক্লা যজুর্বেদ, ৩২:২ বলছে,
.
"All twinklings of the eyelid sprang from **Purusha, resplendent One.**
No one hath comprehended him above, across, or in the midst."
.
[White Yajur Veda, 32:2; translated by Ralph T.H Griffith; source - http://www.sacred-texts.com/hin/wyv/wyvbk32.htm]
.
অর্থাৎ, শুক্লা যজুর্বেদ ৩২:৩ এ যে "তাঁর" কথা বলা হচ্ছিল, সে হল "Purusha" বা "পুরুষ"।
.
এই "পুরুষ"-টা কে? এই "পুরুষ" অর্থ হল "পরমাত্মা" যাকে "নিরাকার ব্রহ্ম" ও বলা যেতে পারে। যারা যারা এই নিরাকার ব্রহ্ম নিয়ে আপত্তি তুলছেন, তাদের বলব দয়া করে এই "পুরুষ" এর ব্যাখ্যাটা তাহলে আপনি আগে দিন।
.
এই নিরাকার ব্রহ্ম আক্ষরিকভাবে সর্বত্র বিরাজমান বলা হয়ে থাকে।
.
শুক্লা যজুর্বেদের ঠিক আগের অধ্যায় থেকেই আমরা পাই:
.
**"PURUSHA** hath a thousand heads, a thousand eyes, a thousand feet.
**Pervading earth on every side** he fills a space ten fingers broad."
.
[White Yajur Veda, 31:1; translated by Ralph T.H Griffith; source - http://www.sacred-texts.com/hin/wyv/wyvbk31.htm]
.
এখানে খেয়াল করুন, "Purusha" বা "পুরুষ" বা "পরমাত্মা" এর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে //Pervading earth on every side// অর্থাৎ, "পরমাত্মা পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে পরিব্যাপ্ত"; আর এই বিষয়কে রূপকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এটা বলে যে, পুরুষ বা পরমাত্মার বিস্তৃতি এমনতর যেন তার হাজারটা মাথা (thousand heads), হাজারটা চোখ (thousand eyes), হাজারটা পা (thousand feet) এবং কোনো একক শূন্যস্থান পূরণ করতে তার দশটা প্রশস্ত আঙুল (ten fingers broad) রয়েছে।
.
যজুর্বেদ ৩২:৪ এ এই বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলা হচ্ছে,
.
"This very God pervadeth all the regions; yea, born aforetime, in the womb he dwelleth.
He verily born and to be born hereafter meeteth his offspring, facing all directions."
.
[White Yajur Veda, 32:4; translated by Ralph T.H Griffith; source - http://www.sacred-texts.com/hin/wyv/wyvbk32.htm]
.
//pervadeth all the regions// বলতে বোঝানো হচ্ছে যে, এই পরমাত্মা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত অর্থাৎ আক্ষরিকভাবে সর্বত্র বিরাজমান।
.
//born aforetime, in the womb he dwelleth// বলতে বোঝায় যে, পরমাত্মা থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হয়ে তা ধ্বংসশীল দেহে প্রবেশ করে আর জীব যখন সন্তান জন্ম দেয়, অর্থাৎ বংশবিস্তার করে তখন প্রতিটি জীবে এই আত্মা বিরাজ করে; তাই //womb he dwelleth// এই কথাটি বলা হচ্ছে এবং এই ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে যে, গর্ভের শিশুর শরীরের আত্মা আসে পরমাত্মা থেকে!
.
ভগবতগীতা বলছে,
.
"এই শরীরে আর একজন পরম ভোক্তা রয়েছেন। তিনি পরম ঈশ্বর, পরম প্রভু, তিনি সকলের সমস্ত কর্মের সাক্ষী এবং অনুমোদন কর্তা। তাকে বলা হয় পরমাত্মা।"
(ভগবতগীতা, ১৩:২৩)
.
চিন্তা করুন, গর্ভের শিশুর শরীরের আত্মা আসছে পরমাত্মার অংশ থেকে, এটা বলা হচ্ছে, আর আপনি সেই পরমাত্মার সাথে আল্লাহ তাআলার সাদৃশ্য দেখে বেড়াচ্ছেন! এটা কি সাদৃশ্য হল???
.
আল্লাহ তাআলা আত্মাও নন, পরমাত্মাও নন। বরং তিনি সকল আত্মা ও যাবতীয় সৃষ্টির একমাত্র সত্য সৃষ্টিকর্তা যিনি আরশের উর্ধ্বে সমস্ত সৃষ্টি হতে পৃথক।
.
إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ فِى سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ ٱسْتَوَىٰ عَلَى ٱلْعَرْشِۖ يُدَبِّرُ ٱلْأَمْرَۖ مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِنۢ بَعْدِ إِذْنِهِۦۚ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمْ فَٱعْبُدُوهُۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
.
"নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, অতঃপর তিনি আরশের উর্ধ্বে সমাসীন হন, তিনি প্রত্যেক কাজ পরিচালনা করে থাকেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশকারী কেউ নেই। ঐ (স্রষ্টা ও পরিচালক) আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?"
(আল-কোরআন, ১০:৩)
.
.
فَاطِرُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِۚ جَعَلَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَٰجًا وَمِنَ ٱلْأَنْعَٰمِ أَزْوَٰجًاۖ يَذْرَؤُكُمْ فِيهِۚ لَيْسَ كَمِثْلِهِۦ شَىْءٌۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْبَصِيرُ
"তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্রষ্টা। তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং চতুস্পদ জন্তুদের মধ্য থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন। কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।"
(আল-কোরআন, ৪২:১১)
.
এবার শুক্লা যজুর্বেদের এই রেফারেন্সটি দেখুন,
.
"So mighty in his grandeur; yea, greater than this is **Purusha.**
**All creatures are one fourth of him,** three fourths eternal life in heaven."
.
[White Yajur Veda, 31:3; translated by Ralph T.H Griffith; source - http://www.sacred-texts.com/hin/wyv/wyvbk31.htm]
.
//All creatures are one fourth of him// বলতে বোঝানো হচ্ছে যে, সমস্ত সৃষ্টি পুরুষ বা পরমাত্মার সাপেক্ষে এতই ক্ষুদ্র যে, সমস্ত সৃষ্টিজগৎ পরমাত্মার অংশের চারভাগের একভাগ। অর্থাৎ, পরমাত্মার অংশের চারভাগের একভাগ জুড়ে জগৎ বিরাজমান। ভগবতগীতা বলছে,
.
"হে পান্ডব, এইভাবে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তুমি আর মোহগ্রস্ত হবে না, যখন জানবে সমস্ত জীবই আমার বিভিন্ন অংশ এবং তারা সকলেই আমাতে অবস্থিত এবং তারা সকলেই আমার।"
(ভগবতগীতা, ৪:৩৫)
.
এখানে হিন্দু দর্শনে ঈশ্বরের জন্ম মৃত্যু নেই বলতে এই আত্মা ও পরমাত্মার জন্ম মৃত্যু নেই বোঝানো হয়েছে। এখানে "সৃষ্টিকর্তা" এর কোনো ধারণাই দেওয়া হয়নি।
.
পুরুষ বা পরমাত্মার অংশ হতে আত্মা পৃথক হয়ে প্রকৃতির সংস্পর্শে এলে সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করে আর সৃষ্টি নিজেকে পরমাত্মা থেকে পৃথক ভাবা শুরু করে, যেখানে সৃষ্টি আসলে মিথ্যা। জীব ভাবছে সৃষ্টি আছে, কিন্তু এটা আসলে বিভ্রম। একেই বলে মায়া। (এই মায়া, শয়তানি শির্ক, কুফর এর ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।)
.
ভগবতগীতা বলছে,
.
"হে অর্জুন, পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।"
(ভগবতগীতা, ১৮:৬১)
.
তাহলে এখানে প্রথমে ছিল নিরাকার পরমাত্মা যার থেকে আত্মা এসে মায়ায় বেষ্টিত হয়ে সাকার বিষয়ের আবির্ভাব ঘটে, বা অন্যভাবে বললে, পুরুষ বা পরমাত্মার প্রকাশ ঘটে মিথ্যা জগতের অস্তিত্ব লাভ করে। সাকার উপাসনার অর্থ প্রথমে সেই মিথ্যা সাকারের মধ্যে থেকে আগে সাকারের ওপর মনোনিবেশ করা। এরপর মায়া থেকে উত্তীর্ণ হলে নিরাকার পরমাত্মায় মনোনিবেশ ঘটে এবং সবশেষে (শয়তানের চূড়ান্ত ওয়াসওয়াসায়) এই বোধ জাগ্রত হয় যে, সৃষ্টি বলে আসলে কিছু নেই। সবই আসলে পরমাত্মা বা অন্য ভাষায় বললে, সবই আসলে "ব্রহ্ম"। সৃষ্টি ভাবাটাই বিভ্রম। আর সেই সর্বোচ্চ বোধ যে, সবই আসলে ব্রহ্ম - এই বোধে যাওয়ার প্রক্রিয়াই হল "Meditation" বা "ধ্যান" ।
.
এবার দেখুন তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ধ্যান সম্পর্কে কী বলছেনঃ
.
"আবু ওয়াক্বেদ আল-লাইষী বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আমরা হুনাইনের পথে বের হলাম। তখন আমরা কুফরের নিকটবর্তী (সদ্য নও-মুসলিম) ছিলাম। মক্কা-বিজয়ের দিন মুসলমান হয়েছিলাম।
.
**(পথে) মুশরিকদের একটি কুল গাছ ছিল; যার নিকটে ওরা ধ্যানমগ্ন হত** এবং (বর্কতের আশায়) তাদের অস্ত্র-শস্ত্রকে তাতে ঝুলিয়ে রাখত; যাকে ‘যা-তে আনওয়াত্ব’ বলা হত।
.
সুতরাং একদা আমরা এক কুল গাছের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম। (তা দেখে) আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাদের জন্য একটি ‘যা-তে আনওয়াত্ব’ ক’রে দিন যেমন ওদের রয়েছে। (তা শুনে) তিনি বললেন, ‘আল্লাহু আকবার! এটাই তো পথরাজি! যার হাতে আমার জীবন আছে তাঁর কসম! তোমরা সেই কথাই বললে, যে কথা বানী ইস্রাঈল মূসাকে বলেছিল, ‘আমাদের জন্য একটা দেবতা গড়ে দিন, যেমন ওদের অনেক দেবতা রয়েছে!’ মূসা বলেছিলেন, ‘তোমরা মূর্খ জাতি।’
.
**অবশ্যই তোমরা একটা একটা ক’রে তোমাদের পূর্ববর্তী (জাতির) পথ অনুসরণ করবে।’’"**
.
(তিরমিযী ২১৮০, মুসনাদ আহমাদ ৫/২১৮ সানাদ সহীহ)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/share.php?hid=65880
.
দেখুন ভাই, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পৌত্তলিক ধ্যানমগ্ন গোষ্ঠীর আমরা অনুসরণ করব - এই ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন। আর যখন আপনি শির্কযুক্ত ধারণায় পরমাত্মার সাথে আল্লাহ তাআলার সাদৃশ্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তখন আপনি কি পরোক্ষভাবে এই হাদিসের ভবিষ্যৎবাণীই পূরণ করছেন না???
.
.
.
- আহমেদ আলি
======================
আরও পড়ুন:
♦ মূর্তিপূজার যুক্তিখণ্ডন
visit - http://uniqueislamblog.blogspot.com/2018/06/blog-post_24.html?m=1
.
♦ মুসলিমরা কি শিবলিঙ্গ আর দেবদেবীর পূজা করে?
visit - http://uniqueislamblog.blogspot.com/2018/06/blog-post_9.html?m=1
Comments
Post a Comment