(বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদের সমন্বয়)
"সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এইভাবে ইন্দ্রিয় এবং ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া উচিত নয়, কারণ তা পরমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।"[১]
.
বিষয়টি আমাদের সবারই জানা; কিন্তু যখনই এই বিষয়টিকে কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তখনই ব্যাপারটা হাই ফাই কিছু একটা বলে মনে হয়। তাহলে সেই বিষয়টা আসলে কী?
.
এটা আর কিছুই নয় - ক্রমাগত সুখ ভোগের লালসা!
.
উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা হয়ত সহজেই বোঝা যাবে। ধরা যাক, একই কলেজের দু'জন ছেলে মেয়ে একে অপরকে প্রথম দেখেই প্রেমে পড়ে গেছে। এখন ছেলে আর মেয়ে কয়েক মাস বা কয়েক বছর প্রেম করার পর ব্রেক আপ হয়ে গেল! এক্ষেত্রে এই ক্রিয়ার মাঝে মূলত যেটি কাজ করছিল, সেটি হল অসন্তুষ্টি! এর মানে হল ছেলে আর মেয়ে একে অপরের প্রতি যখনই আকর্ষিত হয়, তখনই তাদের শান্ত মন অশান্ত হয়ে ওঠে। আর এটি সংঘটিত হয় কামনা হতে প্রাপ্ত তাদের হৃদয়ের অসন্তুষ্টির কারণে। আর তাই বারে বারে হৃদয়কে সন্তুষ্ট করার আশায় বা মনকে শান্ত করার প্রত্যাশা নিয়ে তারা পরস্পর মিলিত হতে থাকে। কিন্তু সামান্য সময়ের মিলনে তাদের মধ্যে সন্তুষ্টির পরিবর্তে কাজ করে উত্তেজনা আর পরস্পর থেকে বিদায়ের ক্ষণে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে তীব্র যন্ত্রণা!
.
"বিষয় ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে সুখ প্রথমে অমৃতের মত এবং পরিণামে বিষের মত অনুভব হয় তাকে রাজস সুখ বলা হয়।"[২]
.
এহেন সুখের আসল চেহারাকে কিছুটা সহজ ভাষায় তুলে ধরতে যে শব্দ ব্যবহার করা যায়, সেটি হল "amusement", অর্থাৎ আনন্দ, ভোগ-বিলাসিতা ইত্যাদি। পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে এক বিরাট অংশই কেবল বেঁচে থাকার মানে বলতে এই আনন্দ উপভোগ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।
.
এক্ষেত্রে সামান্য একটা প্রশ্ন করা হল: এত আনন্দ উপভোগ এর পরও আমরা কতটুকু সন্তুষ্ট???
.
প্রথম সেই উদাহরণে আমরা দেখেছিলাম, প্রেমিক আর প্রেমিকা যখন অভিসারে মিলিত হচ্ছিল, তখন তারা তাদের কামনাকে মিটিয়ে সন্তুষ্ট হতে চেয়েছিল। কিন্তু পরিণামে তারা ভোগ-বিলাসিতার ফাঁদে পড়ে যায় আর প্রশান্তির তুলনায় সামান্য সময়ের আনন্দ আর দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণা লাভ করে। নারী ও পুরুষের কামনার প্রধান পার্থক্য হল, পুরুষ সরাসরি শারীরিক উপভোগ কামনা করে, আর নারী কামনা করে বন্ধুত্বপূর্ণ রোমান্টিক উপভোগ। কিন্তু একজন পুরুষ হাজারটা নারী ভোগ করলেও, আর একজন নারী হাজারটা পুরুষকে সঙ্গ দিলেও এই পৃথিবীতে তারা তাদের কামনা মিটিয়ে সন্তুষ্ট হতে কখনই সক্ষম নয়।
.
এরকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের জীবন থেকেই পাওয়া যাবে যেগুলো নির্দেশ করে যে, আমরা অধিকাংশই প্রচুর পরিমাণে আনন্দ ও বিলাসিতাতে থাকার পরও সন্তুষ্ট নই।
.
আপনার কাছে গাড়ি, বাড়ি, দামী ফোন আর সব ভোগ বিলাসিতার উপকরণ আছে। কিন্তু তবুও আপনি সন্তুষ্ট নন, কারণ আপনার আরও টাকা, বিলাসিতার দ্রব্য প্রয়োজন। আপনার ১০টা দামী পোশাক আছে, ৫টা দামী জুতো আছে। কিন্তু এতকিছু থাকার পরও আপনি সন্তুষ্ট নন!
আপনার ৫টা বাড়ি পর কোনো এক বাড়ির লোকদের হয়ত ঠিকমত খাবারই জোটে না।
অথচ আপনি প্রতিদিনই হয়ত উন্নতমানের খাবার খাচ্ছেন। তবুও ক'দিন পর পরই সেগুলো আর ভালো লাগছে না, বরং অন্য কোনো খাবার টেস্ট করতে মন চাইছে! বিয়ের কয়েক বছর পর আপনার স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি আর হয়ত তেমন কোনো আকর্ষণই আপনার নেই, তাই এখন অন্য কোনো বন্ধু বা বান্ধবীর সাহচর্যের জন্য আপনার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স হয়ত আর দশটা লোকের থেকেও তিনগুণ বেশি। কিন্তু তাও আপনার মনে হচ্ছে আরও কিছু টাকা বাড়াতে পারলে হয়ত ভাল হত।
.
এভাবেই উপভোগ থেকে আমরা সামান্য কিছু সময়ের জন্য আনন্দিত থাকতে পারি ঠিকই, কিন্তু চূড়ান্তরূপে অসন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারি না!
.
স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়:
.
"সুখই চরম লক্ষ্য-এরূপ মনে করা ভ্রম। জগতে আমরা যত দুঃখ দেখিতে পাই, তাহার কারণ-মানুষ অজ্ঞের মত মনে করে, সুখই আমাদের চরম লক্ষ্য। কালে মানুষ বুঝিতে পারে, সুখের দিকে নয়, জ্ঞানের দিকেই সে ক্রমাগত চলিতেছে।"[৩]
.
সুতরাং বলা যায়, আনন্দ আর ভোগের পিছনে ছুটতে থাকা কখনই সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হতে পারে না। তাহলে কীভাবে সন্তুষ্টি সম্ভব?
.
নাস্তিক্যবাদের অনুসারীরা হয়ত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেবেন না; তবে সেক্ষেত্রে অনুরোধ রইল, ধর্মীয় দোষত্রুটি নিয়ে মাতামাতি করার পরিবর্তে তারা যেন এর চেয়ে উত্তম কোনো পথ দেখিয়ে দেন, যা প্রকৃতই সন্তুষ্টি প্রদানে সক্ষম।
.
এক কথায় বলতে গেলে:
.
Satisfaction comes from peace; peace comes from submission and submission comes from remembrance.
.
Therefore, satisfaction really comes from remembrance.
.
অর্থাৎ, সন্তুষ্টি আসে প্রশান্তি হতে; প্রশান্তি আসে সমর্পণ হতে; সমর্পণ আসে স্মরণ হতে।
সুতরাং সন্তুষ্টি আসে প্রকৃতপক্ষে স্মরণ হতে।
.
ব্যাপারটা পেঁচিয়ে গেল তাই না?
.
এটা তেমন কিছুই না। সহজ একটা বিষয়। দেখতেই এত জটিল মনে হচ্ছে!
.
সহজ ভাষায় বললে, প্রেমিক প্রেমিকা যখন উত্তেজিত ছিল, স্বামী বা স্ত্রী যখন অন্য সঙ্গী খুঁজছিল, কোটিপতি যখন ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর আশায় ছিল, তখন তাদের মনে পর্যাপ্ত শান্তি ছিল না, বা অন্যভাবে বললে তাদের হৃদয়ে প্রকৃত শান্তির অভাব ছিল - যেটা আগেই বলা হয়েছে। এর অর্থ এটাই যে, যদি মনে প্রকৃত প্রশান্তি বিরাজ করে, তবেই সন্তুষ্টি আসা সম্ভব। নয়ত তা কখনই সম্ভব নয়। আর একারণেই বলা হয়েছে - Satisfaction comes from peace, অর্থাৎ সন্তুষ্টি আসে প্রশান্তি হতে।
.
কিন্তু এই প্রশান্তিটা কে এনে দেবে? এটা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন!
আর এর উত্তর হল এই প্রশান্তি এনে দেবে আপনার যথার্থ কৃতকর্ম বা কাজ। কিন্তু সেই কাজ আসলে কেমনতর কাজ?
.
এটা বুঝতে ছোট্ট একটা বিষয় খেয়াল করা যাক। যখন রাস্তা দিয়ে কোনো মেয়ে অশ্লীল পোশাকে হেঁটে যাওয়ার সময় কোনো ছেলে তার দিকে বার বার তাকাতে থাকে, তখন সেক্ষেত্রে মেয়েটার মধ্যে যে আনন্দ আর বিরক্তির মিশ্র ভাব কাজ করে, তা আসলে তার সৌন্দর্য আর বিলাসিতার অহংকারের প্রকাশ। এক্ষেত্রে মেয়েটি সেই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে নি, যেটি তার জন্য প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর।
অন্যদিকে ছেলেটি যখন সেই মেয়েকে উপভোগ করছে, তখন সেটি তার উত্তেজনা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের যন্ত্রণা বৃদ্ধিরই বহিঃপ্রকাশ।
উভয় ক্ষেত্রেই তারা নিজ সত্ত্বার ওপর অত্যাচার করছে এবং আনন্দের পিছনে ছুটতে গিয়ে ভোগের যন্ত্রণা আর অসন্তুষ্টির ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে।
.
"বিশ্বাসী পুরুষদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের যৌন অঙ্গকে সাবধানে সংযত রাখে; এটিই তাদের জন্য অধিকতর পবিত্র......
বিশ্বাসী নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থান রক্ষা করে। তারা যা সাধারণতঃ প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য যেন প্রদর্শন না করে...."[৪]
.
তাই এক্ষেত্রে প্রশান্তি আনার জন্য আমরা যেমনতর কাজের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছি সেটি হল এমন পদ্ধতি যাতে নিহিত রয়েছে সৃষ্টিকর্তার স্মরণ। স্মরণ মানে এটা নয় যে, আমি মনে করলাম সৃষ্টিকর্তা আমায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাই আমি তাঁর কথা মনে করলাম একবার আর তারপর আবার বিলাসিতায় মেতে গেলাম!
আবার স্মরণ মানে এটাও নয় যে, বিপদে পড়লে নানাবিধ দেবদেবীকে স্মরণ করে সাহায্য চাইলাম (কেননা দেবদেবী কোনো প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা নয়)।
বরং স্মরণের অর্থ হল একমাত্র চূড়ান্ত সত্য সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য ও নির্ধারিত সেই সীমালঙ্ঘন এর শাস্তিকে স্মরণ করা, যে সীমালঙ্ঘনের কারণে ব্যক্তি ক্রমাগত নিজের ওপর অত্যাচার করে ইহকাল ও পরকালে নিজের কৃতকর্মের শাস্তির সম্মুখীন হয়।
.
অনেকের কাছেই ব্যাপারটা হাস্যকর। সেক্ষেত্রে তাদেরকে নিউটনের সেই সূত্রখানা মনে করিয়ে দিতে চাই যা থেকে তিনি প্রকৃতির সেই নিগূঢ় সত্যটি অনুধাবন করেছিলেন। আর সেটি হল প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।
তাহলে এখন ধরুন, জনৈক হিটলারকে ধরা হল পৃথিবীর আইনে শাস্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাকে মাত্র একবারই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সম্ভব। অথচ সে ত্রিশ লক্ষ নিরীহ ব্যক্তিকে (ইহুদি) হত্যা করেছে। তাহলে এর যথাযথ বিপরীত প্রতিক্রিয়া কী? আমরা জানি, হিটলার সুইসাইডের মাধ্যমে মারা গেছে; তাহলে এখানে তার কৃতকর্মের পরিপূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া কী?
.
বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্রের বর্ণনাতে মতভেদ আছে এই প্রতিক্রিয়া নিয়ে, কিন্তু আমরা মতভেদে যাব না। বরং সবগুলো মতবাদের সমন্বয়ের মাধ্যমে বলব যে, এই প্রতিক্রিয়া হল সেই পরিপূর্ণ ও যথাযথ শাস্তি যা ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে লাভ করে। যদি ইহকালে পূর্ণ শাস্তি লাভ না করে, তবে পরকালে সেই শাস্তি সে ভোগ করবে যদি না সে সৃষ্টিকর্তার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সত্যের পথে ফিরে না আসে!
যদি কেউ আপনার মা আর বোনকে ধর্ষণ করে আর দুষ্কৃতি অবস্থায় সুখে শান্তিতে মারা যায়, তবে এর যথাযোগ্য বিপরীত প্রতিক্রিয়া কী? এটাই নির্দেশ করে যে, সৃষ্টিকর্তার সীমালঙ্ঘনের শাস্তিকে যা আরও বহুবিধ উদাহরণ সাহায্যেও দেখা যায়।
.
"..যে ব্যক্তি কোনো নারীর দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকাল, সে ইতিমধ্যেই তার সাথে অন্তরে ব্যভিচার করে ফেলেছে। যদি তোমার ডান চোখ পাপকর্মে লিপ্ত হয়, তবে (এটাও উত্তম যে) তুমি তা তুলে ছুড়ে ফেলে দাও: কেননা তোমার সমস্ত শরীর নরকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার চেয়ে একটি অঙ্গের বিলুপ্তিও লাভজনক।"[৫]
.
তাই প্রথম বিষয় হল নিজের নেতিবাচক ক্রিয়াকর্মের শাস্তির স্মরণ এর মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং তাঁর যথাযথ আনুগত্য করা; অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার শাস্তিকে ভয় করে পাপকর্ম হতে বিরত থাকা এবং তাঁর নির্দেশাবলি সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘন না করা।
.
তবে ভয় এর মাধ্যমে আনুগত্যের অর্থ হল কেবল পরাজয় স্বীকার করা, যা পরিপূর্ণ শান্তি প্রদান করে না। তবুও শাস্তির ভয় থেকে আনুগত্যের ক্রমাগত চর্চা ব্যক্তিকে ভোগ বিলাসিতা থেকে সংযত হতে সাহায্য করে।
.
যেমন, ব্যক্তি যখন শাস্তি স্মরণ করে কোনো নারীকে ধর্ষণ করা থেকে বিরত থাকে, তখন তার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যের মাধ্যমে সংযম তৈরি হয়।
.
আর এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি ভোগ এবং আনন্দ থেকে প্রাপ্ত অসন্তুষ্টি হতে ধীরে ধীরে সরে আসতে শুরু করে। আর তখনই সে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহকে প্রকৃতরূপে অনুধাবন করার সক্ষমতা লাভ করতে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যক্তি যখন অশ্লীল আনন্দ থেকে সরে আসে, তখন সে প্রকৃতপক্ষে অশ্লীল বিনোদন হতে প্রাপ্ত যন্ত্রণা থেকেও ধীরে ধীরে সরে আসতে থাকে। ফলে তখন তার হৃদয় সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহকে স্মরণের জন্য ধীরে ধীরে উপযুক্ত হতে থাকে। যা সে পূর্বে জানত বা শুনেছিল তা সে উপলব্ধি করতে থাকে। অর্থাৎ সে অনুভব করে যে, এই মহাবিশ্ব আপনা আপনি by chance সৃষ্টি হওয়া অযৌক্তিক। একটা রোবট প্রচন্ড জটিল সৃষ্টি। কিন্তু তা আপনা আপনি যেমন তৈরি হতে পারে না, তেমনি রোবটের চেয়েও জটিল এই মানবদেহ ও সমস্ত মহাবিশ্ব এবং এর মধ্যকার সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মও আপনা আপনি আসতে পারে না! তার অনুভূতিতে ফুটে ওঠে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত খাদ্য, বাতাস, জল প্রভৃতির মর্ম বা তাৎপর্য যার একটিরও অভাবে তার নিশ্চিত প্রাণহানি সম্ভব; ফলে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সকল উপকরণ এর জন্য আত্মসংযত জ্ঞানী ব্যক্তির মনে তার প্রতিপালকের জন্য আপনা থেকেই কৃতজ্ঞতা চলে আসে। মনের কুবাসনা ও আত্ম-অহংকার থেকে সরে এসে নিজের পালনকর্তার প্রতি তার হৃদয় আপনা থেকেই সমর্পিত হয়ে ওঠে।
.
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রকৃত প্রশান্তি আসে সমর্পণ থেকে, আর তাই আমরা বলেছিলাম - Peace comes from submission;
আর যেহেতু এই সমর্পণ এসেছে সৃষ্টিকর্তার স্মরণ থেকে, একারণে - Submission comes from remembrance.
.
নাস্তিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা হয়ত ভাবতে পারেন যে, সৃষ্টিকর্তার স্মরণ, আত্মসংযম, প্রশান্তি এগুলো সবই একপ্রকার দাসত্ব; আর তাই এরূপ দাসত্ব কীভাবে আত্মসন্তুষ্টি প্রদান করতে সক্ষম?
.
এর উত্তর হল এই যে, সৃষ্টির প্রকৃতিই হল দাসত্ব এবং কোনো সৃষ্টিই এই দাসত্ব থেকে মুক্ত নয়। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে এবং সে মহাকর্ষের নিয়মে চলে সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব করে চলেছে। এক্ষেত্রে তার কোনো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই। কিন্তু মানুষ হল ভিন্ন সৃষ্টি যার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে; কিন্তু তারপরও সে এই দাসত্বের বেড়াজাল হতে মুক্ত নয়। মানুষ সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে গিয়ে পড়ে যায় নিজের আর জগতের অন্য বিষয়গুলির দাসত্বে।
.
নিজের দাসত্বে পড়ে ব্যক্তি নিজেকেই প্রভু বলে ভাবা শুরু করে। সে মনে করে যে, তার নেতিবাচক কর্মের কোনো হিসাব কেউ নেবে না। অগোচরে পাপাচারে লিপ্ত হলে কেউ দেখতে আসবে না। স্বেচ্ছাচারিতায় মত্ত হলে কোনো কিছু যাবে আসবে না! এভাবেই নিজের আমিত্বের দাসত্বে সে জড়িয়ে পড়ে। সমর্পণহীনতা থেকে তার মনে জন্ম নিতে থাকে ভোগ-বিলাসিতা, অহংকার প্রভৃতি হতে প্রাপ্ত অসহনীয় যন্ত্রণা!
.
অন্যদিকে ব্যক্তি যখন সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব ছেড়ে দেয়, তখন সে জগতের অন্য বিষয়ের দাসত্বে পতিত হয়। নামকরা ব্যক্তিদের, উচ্চপদস্থ লোকদের সে অন্ধভাবে অনুসরণ করা শুরু করে। ভোগবাদের বিষবাষ্পের সংস্পর্শে খ্যাতিমান ও শক্তিশালী ব্যক্তিদের দোষ-ত্রুটি-অন্যায়কে তার কাছে সুশোভনীয় বলে মনে হতে থাকে। আর এভাবেই ব্যক্তিচিত্ত ঘুরে ঘুরে সেই অসন্তোষের যন্ত্রণার কূপেই ঝাঁপ দেয়!
.
সুতরাং প্রকৃত সন্তুষ্টির একটিই উপায়। আর সেটি হল নিজেকে একমাত্র সত্য সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব তথা আনুগত্যে সঁপে দেওয়া। তাঁর স্মরণেই পাপাচার হতে বিরত থাকা এবং তাঁর অনুগ্রহকেই কৃতজ্ঞ চিত্তে বরণ করা; তাঁর সন্তুষ্টিতেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং তাঁর নির্ধারিত ইতিবাচক পথেই আনন্দ ও সংযমের পথ অবলম্বন করা।
.
"হে প্রশান্ত চিত্ত!
তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে;
অতঃপর আমার অনুগত দাসদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার চির সুখের উদ্যানে প্রবেশ করো।"[৬]
.
.
______________________
তথ্যসূত্র:
[১] ভগবতগীতা, ৩:৩৪
[২] ভগবতগীতা, ১৮:৩৮
[৩] স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী/১ম খণ্ড/কর্মযোগ/কর্ম-চরিত্রের উপর ইহার প্রভাব
[৪] আল-কোরআন, ২৪:৩০-৩১
[৫] "....whosoever looketh on a woman to lust after her hath committed adultery with her already in his heart. And if thy right eye offend thee, pluck it out, and cast it from thee: for it is profitable for thee that one of thy members should perish, and not that thy whole body should be cast into hell." [The KJV Bible, Matthew, 5:28-29]
[৬] আল-কোরআন, ৮৯:২৭-৩০
=======================
Comments
Post a Comment