হিন্দু ধর্মের সাথে ইসলামের সাদৃশ্যতে কী সমস্যা আছে?
সমস্যা একটাই। হিন্দু দর্শনের গোঁড়াতে যে ধর্মীয় তত্ত্ব আছে তা ইসলামের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক! আপনি হয়ত কোনো হিন্দুকে সাদৃশ্য দেখিয়ে দাওয়াত দিচ্ছেন, আমি সেটাতে বাধা দেব না। কারণ এতে সে হয়ত ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই স্টাইলটা ফলো করতে চাই না। কেননা আপনার স্টাইলটা কেবল সেই সব হিন্দুদের সন্তুষ্ট করতে পারে যাদের হিন্দু দর্শন সম্পর্কে খুব বেশি স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু কোনো একজন হিন্দু, যে তার হিন্দু দর্শন আর মতবাদগুলোর ব্যাখ্যা ভালভাবে জানে, তার ওপর আপনার ব্যাখ্যা কোনো প্রভাব ফেলবে না, যদি না তার ইসলামকে মন থেকে মেনে নেওয়ার ইচ্ছা থাকে!
.
এক্ষেত্রে ইসলামের সাথে আপনি আব্রাহিক ফেইথ অর্থাৎ নবী ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর প্রচারিত একেশ্বরবাদ এর ধারণা দ্বারা প্রভাবিত সেমিটিক ধর্মগুলো (যে ধর্মের অনুসারীদের কুরআন ৩:৬৪ আয়াতে "আহলে কিতাব" বলা হয়েছে) এর সাথে সাদৃশ্য খুঁজতে পারেন। কেননা তাদের ক্ষেত্রে তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ইত্যাদি কিতাবের সুস্পষ্ট উল্লেখ কুরআনে আছে, আর এসকল আহলে কিতাবদের ধর্মীয় তত্ত্বের গোঁড়াতে থাকা বিষয়বস্তুও ইসলামের সাথে মিলে যাবে। কিন্তু এরূপ গোঁড়াতে থাকা সাদৃশ্য হিন্দু দর্শনের সাথে পাওয়া যাবে না। ব্যাপারটা একটা উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক।
.
ধরুন আপনি কুরআন আর বাইবেল থেকে মিল খুঁজে দেখালেন, সৃষ্টিকর্তা একজনই। এখানে ট্রিনিটি এর ব্যাখ্যাতে যে সমস্যাটা আসবে সেটা হল এক ঈশ্বরের তিন অবস্থা - পিতা, পুত্র, পবিত্র আত্মা। এই বিষয়টি সহজেই এড়িয়ে চলা যায় আর দেখানো যায় যে, ট্রিনিটি এর কন্সেপ্ট ঈসা(আলাইহিস সালাম) প্রচার করেন নি। যেমন বাইবেলের এই রেফারেন্সটা লক্ষ্যণীয়:
.
"কিন্তু সেই দিন এবং সেই মুহুর্ত সম্পর্কে কোনো মানুষ জানে না, স্বর্গের কোনো দেবদূতও জানে না, কিন্তু কেবল পিতা তা জানেন।"
("But of that day and hour knoweth no man, no, not the angels of heaven, but my Father only.")
.
[The KJV Bible, Matthew, 24:36]
.
.
তাহলে এখানে বলা হচ্ছে যে, কেয়ামত কখন হবে - এটা কেবল পিতা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই জানেন আর কেউ জানে না, মানুষ, ফেরেশতা কেউ না। তাই এখানে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, পিতা, পুত্র আর পবিত্র আত্মা ভিন্ন সত্ত্বা। কারণ তাঁরা একই সত্ত্বা হলে পিতা যা জানেন, পুত্র আর পবিত্র আত্মারও তা জানার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা তা জানেন না।
.
এখন আপনি তাই দেখতে পাবেন যে, বাইবেলের যীশু খ্রিস্টের কথাগুলোকে এক করলে মোটামুটি আপনি ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর প্রচারিত একেশ্বরবাদ এর ইঙ্গিত পাবেন যা ইসলামের মূল বক্তব্যের সাথে মিলে যাচ্ছে।
.
কিন্তু এই টেকনিক হিন্দু দর্শনের বেলায় খাটে না। কারণ হিন্দু দর্শন "নন সেমেটিক ফেইথ" যার বিকৃতি এত বেশি পরিমাণ হয়েছে যে, এই দর্শনকে কেবল মুশরিকি আকিদার আন্ডারে ফেলা ছাড়া আর কোনো সুস্পষ্ট উপায় নেই।
.
উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি ইসলামের সাথে মিল দেখিয়ে হিন্দু গ্রন্থের অনেক জায়গা থেকে রেফারেন্স দিয়ে দেখাবেন যে, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ীও ঈশ্বর একজন, তখন আপনার সামনে হিন্দু দর্শনের মোটামুটি তিন ধরণের ব্যাখ্যা এসে হাজির হবে:
.
১) ঈশ্বর এক বলতে সেটি "অদ্বৈতবাদ" এর বিষয়কে নির্দেশ করে। "অদ্বৈত" বা "Advaita" যার মানে হল "একতা" বা "unity" এর কন্সেপ্ট। এই ধারণা অনুযায়ী সমস্ত সৃষ্টি ঈশ্বরের দেহের মধ্যে অবস্থিত। তাই সমস্ত সৃষ্টিকে, দেব-দেবীকে এক করলে তা এক ঈশ্বরের অনন্ত-অসীম সত্ত্বাকে তুলে ধরবে। এ সম্পর্কে বেদ, মনুসংহিতা, গীতা ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বেশ কিছু রেফারেন্স আছে। আমি আপাতত কেবল গীতা থেকে একটা রেফারেন্স দিচ্ছি।
.
"হে পান্ডব, এইভাবে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তুমি আর মোহগ্রস্ত হবে না, যখন জানবে সমস্ত জীবই আমার বিভিন্ন অংশ এবং তারা সকলেই আমাতে অবস্থিত এবং তারা সকলেই আমার।"
(ভগবতগীতা, ৪:৩৫)
.
২) দ্বিতীয় যে কন্সেপ্টটা আসতে পারে সেটা হল ঈশ্বর নিরাকার। এটা অধিকাংশ হিন্দুরাই মেনে চলে। এক ঈশ্বর বলতে তারা চূড়ান্ত নিরাকার ঈশ্বরকে বোঝায়। এই নিরাকার এক ঈশ্বরকে পরমাত্মা, নির্গুণ ব্রহ্ম ইত্যাদিও বলা হয়ে থাকে। এই নিরাকার ঈশ্বরের এক আধ্যাত্মিক দেহের অংশ থেকে সগুণ ব্রহ্ম অস্তিত্ব লাভ করে, যা থেকে পুরুষ ও প্রকৃতির সমন্বয়ে নানারূপ সৃষ্টির আবির্ভাব ঘটে।
.
৩) তৃতীয় যে কন্সেপ্টটা সামনে আসতে পারে সেটা হল আধুনিক বৈষ্ণব কন্সেপ্ট যে কন্সেপ্টের অনুসারীরা বিশেষ করে ইস্কনের সদস্য। স্বামী প্রভুপাদ এর ভাগবতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এক ঈশ্বর বলতে বোঝায় সগুণ ঈশ্বরকে আর সেই সগুণ ঈশ্বর হল কৃষ্ণ যার আধ্যাত্মিক দেহ থেকে শক্তির বিস্তার ঘটে নিরাকার ব্রহ্মের আবির্ভাব হয়ে থাকে।
.
.
আমার প্রশ্ন হল, একজন মুসলিম হিসেবে আপনি কি এই একেশ্বরবাদ এর এই তিনটি ধারণা মেনে নেবেন না প্রত্যাখান করবেন? অবশ্যই প্রত্যাখান করবেন। আর এই ধারণাগুলো প্রত্যাখান করছেন - এর অর্থ হল আপনি গোটা হিন্দু দর্শনটাই প্রত্যাখান করছেন। তা এটা বলা কোন দিক দিয়ে অযৌক্তিক যখন আমি বলি যে, হিন্দু দর্শনের সাথে ইসলামের কোনো সাদৃশ্য চলে না, কারণ গোঁড়ার কন্সেপ্টটাই আলাদা?
.
যখন আপনি সাদৃশ্য দেখিয়ে বলছেন যে, হিন্দু দর্শনে ঈশ্বর একজনই, তখন একজন হিন্দু অবশ্যই তা মেনে নেবে। কিন্তু আপনি যেহেতু উপরের তিনটি কন্সেপ্টের কোনো জবাবই দিচ্ছেন না, তাই সে ইসলামকে মেনে নিতে বাধ্য নয়।
.
আমি জানি না আপনারা এগুলোর পিছনে কেন পড়ে আছেন? এইসব কুফরি আকিদার সাথে সাদৃশ্য খুঁজতে গেলে ইসলামিক আকিদা সমস্যাযুক্ত হয়ে উঠতে পারে।
.
আমি প্রথমে ঋগ্বেদ থেকে একটা রেফারেন্স দিচ্ছি, এটা গ্রিফিথ এর অনুবাদ করা।
.
"Darkness there was: at first concealed in darkness this All was indiscriminated chaos.
**All that existed then was void and form less**: by the great power of Warmth was born that Unit."
.
(The Rig Veda, Book no. 10, HYMN CXXIX. Creation, Verse no. 3;
tr. Ralph T.H. Griffith, T;
source - http://www.sacred-texts.com/hin/rigveda/rv10129.htm)
.
এখানে ঋগবেদের এই লাইনে সৃষ্টির পূর্বের কথা বলা হচ্ছে যখন ঈশ্বর ছিল "formless" অর্থাৎ নিরাকার। তার অংশ থেকে রূপান্তরিত হয়ে সাকার সৃষ্টির আবির্ভাব হল। আমি এটার স্বপক্ষে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ থেকে একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি। অনুবাদ করেছেন ম্যাক্স মুলার।
.
"By means of thoughts, touching, seeing, and passions **the incarnate Self assumes successively in various places various forms**, in accordance with his deeds, just as the body grows when food and drink are poured into it."
.
(Svetâsvatara Upanishad, FIFTH ADHYÂYA, Verse 11, tr. Max Müller;
source - http://www.sacred-texts.com/hin/sbe15/sbe15104.htm)
.
.
এরকম কথা মনুসংহিতাতেও আছে যে, ঈশ্বর তার নিজের আধ্যাত্মিক দেহ থেকে সৃষ্টির আবির্ভাব ঘটিয়েছেন, ঈশ্বরকে বলা হয়েছে এখানে স্বয়ম্ভু।
.
"He, desiring to produce beings of many kinds **from his own body,** first with a thought created the waters, and placed his seed in them."
.
(The Laws of Manu, 1:8;
tr. George Bühler, source - http://www.sacred-texts.com/hin/manu/manu01.htm)
.
.
শ্রীমদ্ভাগবাতে নির্গুণ ব্রহ্ম এর কথা বলা হচ্ছে যেখানে এই নির্গুণ ব্রহ্ম হল নিরাকার যাকে "impersonal Brahman" বলা হচ্ছে। আবার ঈশ্বরকে একই সাথে পরমাত্মা আর সাকার ভগবানও বলা হচ্ছে।
.
"Learned transcendentalists who know the Absolute Truth call this nondual substance Brahman, Paramātmā or Bhagavān."
.
(Srimad-Bhagavatam - First Canto -Chapter 2: Divinity and Divine Service;
source - https://vanisource.org/wiki/SB_1.2.11)
.
.
তাই ভাই আবারও বলছি এসব শির্ক আর কুফর সিস্টেমের সাথে সাদৃশ্য খুঁজতে যাবেন না, তাহলে বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতে পারেন!!!
[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...
Comments
Post a Comment