(বিদআতীদের অপব্যাখ্যার জবাব)
.
.
=> ভূমিকা:
.
আজ মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নানা ধরণের বিদআত প্রবেশ করেছে যার মধ্যে অন্যতম একটি বিদআত হল ওলী-আউলিয়াদের মাধ্যম বানিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা। এ সম্পর্কে সমাজে বহু অপব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে।
.
তাই আল্লাহর প্রকৃত ওলী সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য এ বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
.
.
=> "আল্লাহর ওলী" এর শাব্দিক অর্থ:
.
আল্লাহর ওলী বলতে অনেক সময় আল্লাহর বন্ধুও বলা হয়ে থাকে। ওলী এর অর্থ প্রসঙ্গে তাফসিরে আহসানুল বয়ানে বলা হচ্ছে:
.
"...'আওলিয়া' শব্দটি ওলীর বহুবচন। যার আভিধানিক অর্থ হল, নিকটবর্তী। এর পরিপ্রেক্ষিতে আওলিয়াউল্লাহর অর্থ হবে, ঐ সকল নেক ও খাঁটি মু'মিন ব্যক্তিগণ, যাঁরা আল্লাহর আনুগত্য করে এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে দূরে থেকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন..."[১]
.
.
=> আল্লাহর ওলী সম্পর্কিত একটি সহিহ হাদিস:
.
প্রথমেই দলিল হিসেবে আমরা আল্লাহর ওলী সম্পর্কিত একটি সহিহ হাদিস দেখব।
.
"উমার বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কিছু লোক আছে যারা নবী নয়, শহীদও নয়। অথচ নবী ও শহীদগণ আল্লাহর নিকট তাদের মর্যাদা দেখে ঈর্ষা করবেন।’’
লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল, আমাদেরকে বলে দিন, তারা কারা?’
.
***তিনি বললেন, ‘‘ঐ লোক হল তারা, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আপোসে বন্ধুত্ব কায়েম করে; যাদের মাঝে কোন আত্মীয়তার বন্ধন থাকে না এবং থাকে না কোন অর্থের লেনদেন।***
.
আল্লাহর কসম! তাদের মুখমণ্ডল হবে জ্যোতির্ময়। তারা নূরের মাঝে অবস্থান করবে। লোকেরা যখন ভীত-সন্ত্রস্ত হবে, তখন তারা কোন ভয় পাবে না এবং লোকেরা যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে, তখন তাদের কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না।
.
**আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সতর্ক হও! নিশ্চয় যারা আল্লাহর বন্ধু,** তাদের কোন ভয় নেই। তারা দুঃখিতও হবে না। যারা মুমিন এবং পরহেযগার। তাদের জন্য ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে রয়েছে সুসংবাদ। আল্লাহর বাক্যাবলীর কোন পরিবর্তন নেই। এটাই হল মহাসাফল্য।’’ (সূরা ইউনুস ৬২-৬৪)"[২]
.
.
সুতরাং, উক্ত হাদিস অনুযায়ী, আল্লাহর ওলীদের বৈশিষ্ট্য হল: যাদের মাঝে কোন আত্মীয়তার বন্ধন বা লেনদেন না থাকা সত্ত্বেও কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই আপোসে বন্ধুত্ব কায়েম করে।
.
অর্থাৎ এরূপ আল্লাহর ওয়াস্তে সত্যিকার বন্ধুত্ব যদি আপনার সাথে অন্য কোনো নেক মুমিন বান্দার কায়েম হয়, তবে হাদিসের বক্তব্যের উক্ত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আপনি এবং সেই নেক মুমিন বান্দাও হবেন আল্লাহর বন্ধু বা আল্লাহর ওলী।
.
.
=> কোরআন অনুযায়ী 'আল্লাহর ওলী' এর সংজ্ঞা:
.
কোরআনে আল্লাহ তাআলা আল্লাহর ওলীদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলছেন:
.
أَلَآ إِنَّ أَوْلِيَآءَ ٱللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَكَانُوا۟ يَتَّقُونَ
لَهُمُ ٱلْبُشْرَىٰ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَفِى ٱلْءَاخِرَةِۚ لَا تَبْدِيلَ لِكَلِمَٰتِ ٱللَّهِۚ ذَٰلِكَ هُوَ ٱلْفَوْزُ ٱلْعَظِيمُ
.
"জেনে রেখ! আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই আর তারা দুঃখিতও হবে না।
যারা ঈমান আনে আর তাকওয়া অবলম্বন করে।
তাদের জন্য সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে আর আখেরাতেও। আল্লাহর কথার কোন হেরফের হয় না, এটাই হল বিরাট সাফল্য।"[৩]
.
এখানে আল-কোরআন ১০:৬৩ আয়াত অনুযায়ী, যারা ঈমান আনবে ও তাকওয়া অবলম্বন করবে, তারাই হবে আল্লাহর ওলী। অর্থাৎ আপনিও যদি সঠিকভাবে ঈমান আনতে পারেন ও তাকওয়া অবলম্বন করেন, তবে আপনিও হবেন আল্লাহর ওলী!
.
.
=> আল্লাহর ওলীরা ইবাদত ও দুয়া এর মাধ্যম নয়:
.
অনেকে দাবি করে থাকেন যে, আপনার ঈমান ও অন্তর শুদ্ধ নয় বলে আপনাকে আল্লাহর ওলীদের কাছে যেতে হবে, যাতে করে তাদেরকে মাধ্যম করে আপনি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারেন।
.
আমাদের প্রশ্ন হল, যে পদ্ধতিতে আল্লাহর ওলী হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে মাধ্যম বিবেচনা করে আপনি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করছেন, সেই পদ্ধতিটি কি ফরজ না সুন্নাত?
আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য যদি মাধ্যমের প্রয়োজন হয়, তাহলে মুশরিকরাও মূর্তিপূজা আর সাধু-সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করে; তাহলে এক্ষেত্রেও তো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়!
.
আল্লাহ তাআলা এহেন সকল প্রকার ইবাদত পদ্ধতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলছেন:
.
أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلْخَالِصُۚ وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِهِۦٓ أَوْلِيَآءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلْفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِى مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِى مَنْ هُوَ كَٰذِبٌ كَفَّارٌ
.
"জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদাত-আনুগত্য। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে আল্লাহ নিশ্চয় সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।"[৪]
.
অনেকে আল্লাহর জীবিত ওলীদের কাছে দুয়া করে থাকে যাতে করে সেই দুয়া তাদের উসিলায় আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়।
.
আল্লাহ তাআলা এহেন দুয়া পদ্ধতিরও প্রতিবাদ করে ঘোষণা করছেন:
.
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِى عَنِّى فَإِنِّى قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا۟ لِى وَلْيُؤْمِنُوا۟ بِى لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
.
"যখন আমার সেবকবৃন্দ (বান্দা) আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করে তখন তাদেরকে বলে দাওঃ নিশ্চয়ই আমি সন্নিকটবর্তী। কোন আহবানকারী যখনই আমাকে আহবান করে তখনই আমি তার আহবানে সাড়া দিই; সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমাকে বিশ্বাস করে - তাহলেই তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত হতে পারবে।"[৫]
.
আবার মৃত ব্যক্তিদের উসিলা বানিয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাছে দুয়া করা হয়, যার বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করছেন:
.
"...তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। সার্বভৌমত্ব তাঁরই। আর তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুরের আঁটির উপরে পাতলা আবরণ বরাবর (অতি তুচ্ছ) কিছুরও মালিক নয়।
.
তোমরা তাদের আহবান করলে তারা তোমাদের আহবান শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের আহবানে সাড়া দেবে না। তোমরা তাদেরকে যে অংশী করছ, তা ওরা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। আর সর্বজ্ঞ (আল্লাহ)র ন্যায় কেউই তোমাকে অবহিত করতে পারে না।"[৬]
.
আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী তাঁর "কুরআন ও হাদীছের মানদন্ডে সুফীবাদ" গ্রন্থে লিখেছেন:
.
"সুফীদের বিরাট একটি অংশ নবী-রাসূল এবং জীবিত ও মৃত অলী-আওলীয়াদের কাছে দুআ করে থাকে। তারা বলে থাকেঃ ইয়া জিলানী, ইয়া রিফাঈ, ইয়া রাসূলুল্লাহ ইত্যাদি। অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁকে ছাড়া অন্যেকে আহবান করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করবে, সে মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
.
وَلا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَنْفَعُكَ وَلا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِين
.
‘‘তুমি আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুকে ডাকবে না যে তোমার উপকার কিংবা ক্ষতি কোনটিই করতে পারে না। যদি তুমি তাই কর তবে তুমি নিশ্চিত ভাবেই জালেমদের মধ্যে গন্য হবে। (সূরা ইউনুসঃ ১০৬)।
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
.
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ
.
‘‘এবং ঐ ব্যক্তির চেয়ে আর কে বেশী পথভ্রষ্ট যে আল্লাহ ব্যতীত এমন ব্যক্তিদেরকে আহবান করে যারা কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না এবং তারা তাদের ঐ আহবান থেকে সম্পূর্ণ বেখবর রয়েছে? (সূরা আহকাফঃ ৫)"[৭]
.
.
আব্দুল হামীদ ফাইযী তাঁর "দ্বীনী প্রশ্নোত্তর" গ্রন্থে লিখেছেন:
.
"‘ইয়া রাসুলুল্লাহ’, ‘ইয়া আলী’, বা ‘ইয়া জীলানী’, বলা বৈধ কি?
.
উদ্দেশ্য যদি আপদে-বিপদে আহবানে বা সাহায্য প্রার্থনা করা হয়, তাহলে তা শিরকে আকবর। এমন শিরক মুসলিমকে ইসলাম থেকে খারিজ ক’রে দেয়।
মহান আল্লাহ বলেন, “অথবা তিনি, যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীর প্রতিনিধি করেন। আল্লাহ্র সঙ্গে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই উপদেশ গ্রহণ ক’রে থাক।" (নামলঃ৬২)
.
“সে, ব্যাক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে, যে আল্লাহ্র পরিবর্তনে এমন কিছুকে ডাকে, যা কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তাঁর ডাকে সাড়া দেবে না? আর তারা তাঁদের ডাক সম্বন্ধে অবহিতও নয়।”(আহকাফঃ৫)
.
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কোন সৃষ্টির কাছে সাহায্য প্রার্থনার আহবান তিন শর্তে বৈধঃ
১। যার নিকট সাহায্য চাওয়া হবে, তাঁকে পার্থিব জীবনে জীবিত থাকতে হবে।
২। তাকে উপস্থিত বা আহবান শুনতে পাচ্ছে এমন অবস্থায় থাকতে হবে।
৩। যে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে, সে সাহায্য করার মতো তাঁর ক্ষমতা থাকতে হবে।
(দলীল ‘তাওহীদ-কৌমুদী’তে দ্রঃ)"[৮]
.
.
=> আল্লাহর ওলী সম্পর্কিত পীর ও বুজুর্গদের চালু করা জাল হাদিস:
.
বর্তমান মুসলিম সমাজের এক বিরাট অংশের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা কোনোরূপ যাচাইকরণ ছাড়াই বিভিন্ন জাল হাদিস আর অপব্যাখ্যাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে আল্লাহর ওলী জ্ঞানে পীর, বুজুর্গ প্রভৃতিদের আনুগত্য করে।
.
এ সম্পর্কে ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বলেন:
.
"হাদীসের গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে হাদীস উল্লেখ করা হয়। তাফসীর, ফিকহ, ওয়ায, আখলাক, ফযীলত, তাসাউফ, দর্শন, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকাদিতে অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়। সাধারণত এ সকল গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস উল্লেখ করা হয়। অনেকেই অজ্ঞতা বশত ধারণা করেন যে, এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ নিশ্চয় যাচাই বাছাই করে হাদীসগুলো লিখেছেন। সহীহ না হলে কি আর তিনি হাদীসটি লিখতেন?
.
এ ধারণাটিও ভিত্তিহীন, ভুল এবং উপরের ধারণাটির চেয়েও বেশি বিভ্রান্তিকর। সাধারণত প্রত্যেক ইল্মের জন্য পৃথক ক্ষেত্র রয়েছে। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বিষয়ের আলিম অন্য বিষয়ে অত বেশি সময় দিতে পারেন না। মুফাস্সির, ফকীহ, ঐতিহাসিক, সূফী, ওয়ায়িয ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মরত আলিম ও বুযুর্গ স্বভাবতই হাদীসের নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনার গভীরতায় যেতে পারেন না। সাধারণভাবে তাঁরা হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচলিত গ্রন্থ, জনশ্রুতি ও প্রচলনের উপরে নির্ভর করেন। এজন্য তাঁদের গ্রন্থে অনেক ভিত্তিহীন, সনদহীন ও জাল কথা পাওয়া যায়।
.
আল্লামা নাবাবী তাঁর ‘‘তাকরীব’’ গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ূতী তাঁর ‘‘তাদরীবুর রাবী’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে অনেক মিথ্যা কথাকে কিছু বুযুর্গ দরবেশ হাদীস বলে সমাজে চালিয়েছেন। কোনো কোনো মুফাসসির, যেমন - আল্লামা আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আস সা’লাবী নিশাপূরী (৪২৭ হি.) তাঁর ‘‘তাফসীর’’ গ্রন্থে, তাঁর ছাত্র আল্লামা আলী ইবন আহমাদ আল-ওয়াহিদী নিশাপূরী (৪৬৮ হি.) তাঁর ‘‘বাসীত’’, ‘‘ওয়াসিত’’, ‘‘ওয়াজীয’’ ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে, আল্লামা আবুল কাসেম মাহমূদ ইবন উমার আয-যামাখশারী (৫৩৮ হি.) তাঁর ‘‘কাশ্শাফ’’ গ্রন্থে, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবন উমার আল-বাইযাবী (৬৮৫ হি.) তাঁর ‘‘আনওয়ারুত তানযীল’’ বা ‘‘তাফসীরে বাইযাবী’’ গ্রন্থে এসকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এ কাজটি করে ভুল করেছেন।
.
সুয়ূতী বলেন : ‘‘ইরাকী (৮০৬ হি.) বলেছেন যে, প্রথম দুজন - সা’লাবী ও ওয়াহিদী সনদ উল্লেখপূর্বক এসকল বানোয়াট বা জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন। ফলে তাঁদের ওজর কিছুটা গ্রহণ করা যায়, কারণ তাঁরা সনদ বলে দিয়ে পাঠককে সনদ বিচারের দিকে ধাবিত করেছেন, যদিও মাওযূ বা মিথ্যা হাদীস সনদসহ উল্লেখ করলেও সাথে সাথে তাকে ‘মাওযূ’ না বলে চুপ করে যাওয়া জায়েয নয়। কিন্তু পরবর্তী দুইজন - যামাখশারী ও বাইযাবী-এর ভুল খুবই মারাত্মক। কারণ, তাঁরা সনদ উল্লেখ করেন নি, বরং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে সরাসরি সুস্পষ্টভাবে এ সকল বানোয়াট কথা উল্লেখ করেছেন।
.
৪র্থ হিজরী শতাব্দীর সুপ্রসিদ্ধ সূফী ও বুজুর্গ শাইখ আবূ তালিব মাক্কী মুহাম্মাদ ইবন আলী (৩৬৮হি)। তাঁর রচিত ‘কুতুল কুলূব’ বা ‘হৃদয়ের খোরাক’ বইটি তাসাউফের জগতে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। পরবর্তী যুগের প্রসিদ্ধতম আলিম ও সূফী হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবূ হামিদ গাযালী মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ (৫০৫ হি)। তাঁর রচিত ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থটি মুসলিম জগতের প্রসিদ্ধতম গ্রন্থগুলির অন্যতম। তাঁদের বুজুর্গি এবং তাঁদের গ্রন্থগুলির প্রতি শ্রদ্ধা-সহ উম্মাতের আলিমগণ এগুলির মধ্যে বিদ্যমান জাল হাদীসগুলি চিহ্নিত করেছেন। মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি) এ সকল গ্রন্থে বিদ্যমান জাল হাদীস সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন: ‘‘কুতুল কুলুব, এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন, তাফসীরে সা’লাবী ইত্যাদি গ্রন্থে হাদীসটির উল্লেখ আছে দেখে ধোঁকা খাবেন না।
.
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী ফিক্হের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলির নাম ও পর্যায় বিন্যাস উল্লেখ করে বলেন: ‘‘আমরা ফিকহী গ্রন্থাবলির নির্ভরযোগ্যতার যে পর্যায় উল্লেখ করলাম তা সবই ফিকহী মাসায়েলের ব্যাপারে। এ সকল পুস্তকের মধ্যে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর বিশুদ্ধতা বা নির্ভরযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস মোটেও প্রযোজ্য নয়। এরূপ অনেক নির্ভরযোগ্য ফিকহী গ্রন্থ রয়েছে যেগুলোর উপর মহান ফকীহগণ নির্ভর করেছেন, কিন্তু সেগুলো জাল ও মিথ্যা হাদীসে ভরপুর। বিশেষত ‘ফাতওয়া’ বিষয়ক পুস্তকাদি। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সকল পুস্তকের লেখকগণ যদিও ‘কামিল’ ছিলেন, তবে হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অসতর্ক ছিলেন।’’
.
এজন্য মুহাদ্দিসগণ ফিক্হ, তাফসীর, তাসাঊফ, আখলাক ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থে উল্লিখিত হাদীসগুলি বিশেষভাবে নিরীক্ষা করে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবন আবু বকর আল-মারগীনানী (৫৯৩ হি.) তাঁর লেখা ফিকাহ শাস্ত্রের প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘‘হেদায়া’’-য় অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি ফকীহ হিসাবে ফিকহী মাসায়েল নির্ধারণ ও বর্ণনার প্রতিই তাঁর মনোযোগ ও সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন বা পড়েছেন তা বাছবিচার না করেই লিখেছেন। তিনি কোনো হাদীসের সহীহ বা যয়ীফ বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করতে যান নি। পরবর্তী যুগে আল্লামা জামালুদ্দীন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবন ইউসূফ যাইলায়ী হানাফী (৭৬২ হি.), আল্লামা আহমাদ ইবন আলী ইবন হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.) প্রমুখ মুহাদ্দিস এসকল হাদীস নিয়ে সনদভিত্তিক গবেষণা করে এর মধ্যথেকে সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস নির্ধারণ করেছেন।
.
অনুরূপভাবে ইমাম গাযালী এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে ফিক্হ ও তাসাউফ আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি দার্শনিক ও ফকীহ ছিলেন, মুহাদ্দিস ছিলেন না। এজন্য হাদীসের সনদের বাছবিচার না করেই যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে আল্লামা যাইনুদ্দীন আবুল ফাদ্ল আব্দুর রহীম ইবন হুসাইন আল-ইরাকী (৮০৬ হি.) ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তাঁর উল্লিখিত হাদীসসমূহের সনদ-ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষণ করে সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসগুলো নির্ধারণ করেছেন । এছাড়া ৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনু আলী সুবকী (৭৭১ হি) ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে উল্লেখিত কয়েক শত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস একটি পৃথক পুস্তকে সংকলিত করেছেন। পুস্তকটির নাম ‘আল-আহাদীস আল্লাতী লা আস্লা লাহা ফী কিতাবিল এহইয়া’, অর্থাৎ ‘এহইয়া.. গ্রন্থে উল্লিখিত ভিত্তিহীন হাদীসসমূহ’।"[৯]
.
.
=> পীর ও বুজুর্গদের দাবি অনুযায়ী তাদের ওপর নাযিলকৃত ওহী বর্জনীয়:
.
এক শ্রেণির লোক আছে যারা পীর, বুজুর্গদের স্বপ্নে পাওয়া কথা বা অন্য প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত কোনো বিষয়কে আল্লাহর ওহীর সমতুল্য মনে করে সেগুলোর ওপর আমল করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা এসকল ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে ঘোষণা করছেন:
.
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ ٱفْتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًا أَوْ قَالَ أُوحِىَ إِلَىَّ وَلَمْ يُوحَ إِلَيْهِ شَىْءٌ وَمَن قَالَ سَأُنزِلُ مِثْلَ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُۗ وَلَوْ تَرَىٰٓ إِذِ ٱلظَّٰلِمُونَ فِى غَمَرَٰتِ ٱلْمَوْتِ وَٱلْمَلَٰٓئِكَةُ بَاسِطُوٓا۟ أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوٓا۟ أَنفُسَكُمُۖ ٱلْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ ٱلْهُونِ بِمَا كُنتُمْ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ غَيْرَ ٱلْحَقِّ وَكُنتُمْ عَنْ ءَايَٰتِهِۦ تَسْتَكْبِرُونَ
.
"ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় জালেম কে হবে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলেঃ আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ তার প্রতি কোন ওহী আসেনি এবং যে দাবী করে যে, আমিও নাযিল করে দেখাচ্ছি যেমন আল্লাহ নাযিল করেছেন। যদি আপনি দেখেন যখন জালেমরা মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকে এবং ফেরেশতারা স্বীয় হস্ত প্রসারিত করে বলে, বের কর স্বীয় আত্মা! অদ্য তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহর উপর অসত্য বলতে এবং তাঁর আয়াত সমূহ থেকে অহংকার করতে।"[১০]
.
ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তাঁর "হাদীসের নামে জালিয়াতি" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:
.
"হাদীস বিচারের ক্ষেত্রে কাশফের কোনোই অবদান নেই। কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া নিয়ামত মাত্র, আনন্দ ও শুকরিয়ার উৎস। ইচ্ছামতো প্রয়োগের কোনো বিষয় নয়। আল্লাহ তা’আলা উমার (রা)-কে কাশফের মাধ্যমে শত শত মাইল দূরে অবস্থিত সারিয়ার সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখিয়েছিলেন, অথচ সে উমারকে (রা) হত্যা করতে তাঁরই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আবু লু’লুর কথা তিনি টের পেলেন না।
.
এছাড়া কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি দ্বারা কখনোই হক বাতিলের বা ঠিক বেঠিকের ফয়সালা হয় না। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ ও সমস্যা ঘটেছে, কখনোই একটি ঘটনাতেও তাঁরা কাশফ, ইলহাম, স্বপ্ন ইত্যাদির মাধ্যমে হক বা বাতিল জানার চেষ্টা করেন নি। খুলাফায়ে রাশেদীন - আবু বাকর, উমার, উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর দরবারে অনেক সাহাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারীর ভুলভ্রান্তির সন্দেহ হলে তাঁরা সাক্ষী চেয়েছেন অথবা বর্ণনাকারীকে কসম করিয়েছেন। কখনো কখনো তাঁরা বর্ণনাকারীর ভুলের বিষয়ে বেশি সন্দিহান হলে তার বর্ণিত হাদীসকে গ্রহণ করেন নি। কিন্তু কখনোই তাঁরা কাশফে মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য বিচার করেন নি। পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন, শুনেছেন ও হাদীসের সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট নির্ধারণের জন্য সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা নিয়েছেন। বর্ণনাকারীর অবস্থা অনুসারে হাদীস গ্রহণ করেছেন বা যয়ীফ হিসেবে বর্জন করেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা কাশফের উপর নির্ভর করেননি।
.
হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের জন্য সনদের উপর নির্ভর করা সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সুন্নাতে সাহাবা। আর এ বিষয়ে কাশফ, ইলহাম বা স্বপ্নের উপর নির্ভর করা খেলাফে-সুন্নাত, বিদ‘আত ও ধ্বংসাত্মক প্রবণতা।"[১১]
.
.
=> অলৌকিকতা সত্য বিচারের চূড়ান্ত মানদণ্ড নয়:
.
যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মুজিযা বা অলৌকিক বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপসমৃদ্ধ নিদর্শন দেখিয়েছেন। কিন্তু সেই অলৌকিকতাকে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব বা ওহীর মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করে সত্যকে বিচার করতে হবে। যেমন ঈসা(আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জন্মান্ধ কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করে দিয়েছিলেন। খ্রিস্টান আর হিন্দুদের একটা বিরাট অংশ এই সকল মুজিযা থেকে এভাবে ব্যাখ্যা গ্রহণ করে যে, ঈসা(আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন নিজে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের কোনো অবতার।
কিন্তু ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা এই মুজিযার ব্যাখ্যা করব আল্লাহর নাযিলকৃত ওহী এর মাধ্যমে যেখানে আল্লাহ তাআলা ঈসা(আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে বলেছেন:
.
وَرَسُولًا إِلَىٰ بَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ أَنِّى قَدْ جِئْتُكُم بِـَٔايَةٍ مِّن رَّبِّكُمْۖ أَنِّىٓ أَخْلُقُ لَكُم مِّنَ ٱلطِّينِ كَهَيْـَٔةِ ٱلطَّيْرِ فَأَنفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًۢا بِإِذْنِ ٱللَّهِۖ وَأُبْرِئُ ٱلْأَكْمَهَ وَٱلْأَبْرَصَ وَأُحْىِ ٱلْمَوْتَىٰ بِإِذْنِ ٱللَّهِۖ وَأُنَبِّئُكُم بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِى بُيُوتِكُمْۚ إِنَّ فِى ذَٰلِكَ لَءَايَةً لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
.
"(তিনি) বনী ইস্রাইলদের জন্য তাকে রসূল করবেন। (সে বলবে,) আমি তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের কাছে নিদর্শন এনেছি। আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা একটি পাখি সদৃশ আকৃতি গঠন করব, অতঃপর আমি তাতে ফুঁ দেব, ফলে আল্লাহর অনুমতিক্রমে তা পাখি হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে মৃতকে জীবন্ত করব। আর তোমরা তোমাদের গৃহে যা আহার কর ও জমা করে রাখ, তা তোমাদেরকে বলে দেব। নিশ্চয় এতে তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।"[১২]
.
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে আহসানুল বয়ানের এক স্থানে বলা হয়েছে:
"দ্বিতীয়বার 'আল্লাহর অনুমতিক্রমে' বলার উদ্দেশ্য হল, কোন মানুষ যেন এমন ভুল বোঝার শিকার না হয়ে পড়ে যে, আমিও আল্লাহর গুণাবলী অথবা কোন এখতিয়ারের অধিকারী। না, আমি তো কেবল তাঁর একজন অক্ষম বান্দা এবং রসূল। আমার দ্বারা যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে, তা হল নিছক মু'জিযা যা কেবল আল্লাহরই নির্দেশে সংঘটিত হয়।"[১৩]
.
.
সুতরাং বলা যায় যে, মুজিযা হল কেবল নিদর্শন, কিন্তু সত্য বিচারের চূড়ান্ত মানদণ্ড হল আল্লাহ নাযিলকৃত ওহী। আর কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর নাযিলকৃত ওহী সম্বলিত সর্বশেষ ও চূড়ান্ত কিতাব হল আল-কোরআন যেটিই হবে সত্য-মিথ্যার চূড়ান্ত মানদণ্ড।
.
إِنَّهُۥ لَقَوْلٌ فَصْلٌ
وَمَا هُوَ بِٱلْهَزْلِ
.
"কুরআন (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী বাণী এবং তা কোন হাসি-ঠাট্টামূলক কথা নয়।"[১৪]
.
এখন এই চূড়ান্ত মানদণ্ডের সাপেক্ষে আল্লাহর ওলীদের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দুইভাবে বিবেচ্য:
.
১) আল্লাহর নেক বান্দাদের মাধ্যমে অলৌকিক নিদর্শন:
.
তাফসিরে আহসানুল বয়ানে আল-কোরআন ১০:৬২ আয়াতের তাফসিরে এক জায়গায় বলা হচ্ছে:
.
"...কিছু মানুষের ধারণা যে, ওলী হতে হলে কারামত দেখানো জরুরী। অতঃপর তারা মনগড়া ওলীদের জন্য সত্য-মিথ্যা কিছু কারামতের কথা প্রচার করে থাকে। এ ধারণা ও কর্ম নেহাতই ভ্রান্ত। ওলী হওয়ার সাথে কারামতের না কোন সম্পর্ক আছে, আর না কারামত ওলী হওয়ার জন্য শর্ত।
.
**এটা স্বতন্ত্র ব্যাপার যে, যদি কোন ওলী দ্বারা কোন কারামত প্রকাশ হয়ে যায়, তবে তা আল্লাহর ইচ্ছা, তাতে সেই বুযুর্গের ইচ্ছা প্রবিষ্ট থাকে না।**
কিন্তু কোন মুত্তাকী মু'মিন এবং সুন্নতের অনুসারী দ্বারা কোন কারামত প্রকাশ হোক বা না হোক, তাঁর বিলায়াতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।"[১৫]
.
অর্থাৎ, কখনও কখনও নেক বান্দাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা অলৌকিক নিদর্শন দেখালে সেটা কেবল আল্লাহরই ইচ্ছাধীন। এতে ঐ ব্যক্তির কোনো কৃতিত্ব নেই।
.
.
২) অলৌকিকতায় শয়তানের সাহচর্য:
.
মহান আল্লাহ ঘোষণা করছেন:
.
وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ ٱلرَّحْمَٰنِ نُقَيِّضْ لَهُۥ شَيْطَٰنًا فَهُوَ لَهُۥ قَرِينٌ
.
"যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য শয়ত্বানকে নিয়োজিত করি, অতঃপর সে হয় তার ঘনিষ্ঠ সহচর।"[১৬]
.
এই প্রসঙ্গে ওয়াহীদ বিন আব্দুস সালাম বালী তাঁর "যাদুকর ও জ্যোতিষীর গলায় ধারালো তরবারি" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:
.
"আল্লামা মাযরী বলেনঃ যাদু, মুজেযা এবং কেরামতের মধ্যে পার্থক্য হল, যাদুর মধ্যে যাদুকর কিছু মন্ত্র ও কর্মের বিশেষ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বীয় স্বার্থ অর্জন করে থাকে। অন্যদিকে কেরামত হঠাৎ অলৌকিক ভাবে ঘটে থাকে। আর মুজেযা কেরামত থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এজন্য যে, তা দ্বারা প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
.
হাফেজ ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) ইমামুল হারামাইনের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন যে, সকলের একমত যাদু কেবলমাত্র ফাসেকের (অতি পাপী) হাত দ্বারাই প্রকাশ পায়। অন্যদিকে কেরামতের প্রকাশ কোন ফাসেকের হাতে হয় না।
.
ইবনে হাজার (রাহেমাহুল্লাহ) আরও বলেন, সকলকেই সচেতন থাকতে হবে যে, অস্বাভাবিক ও অসাধারণ বিষয় যদি কোন শরীয়তের অনুগত কবিরা গুনাহ মুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে প্রকাশ পায় তা হবে কেরামত, অন্যথায় তা হবে যাদু। কেননা যাদু শয়তানের সাহায্যে হয়ে থাকে।
.
নোটঃ কখনও কখনও এমনও হতে পারে যে, কোন ব্যক্তি যাদুকর নয় এমন কি যাদু সম্পর্কে কিছুই জানে না, শরীয়তের যথাযথ অনুসারীও নয় বরং বড় বড় পাপ কর্ম করে থাকে, অথবা কবর পূজারী ও বেদআতী এরপরও দেখা যায় যে, তার থেকে অলৌকিক কিছু ঘটছে।
.
***এর রহস্য হল যে, তাকে শয়তান সহযোগিতা করে থাকে যাতে সাধারণ মানুষ তার বিদআতী তরকায় আকৃষ্ট হয়। আর লোকজন এই সুন্নাতকে ত্যাগ করে শয়তানী পদ্ধতিকে গ্রহণ করে। এ ধরণের ঘটনা অনেক, বিশেষ করে সূফী তরীকার নেতাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।"***[১৭]
.
.
=> শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন এর ফতোয়া:
.
লেখাটির শেষ প্রান্তে এসে আমরা এবার উপরিউক্ত বর্ণনার সারাংশ হিসেবে শাইখ উসাইমীন এর একটি ফতোয়ার উল্লেখ করব যেখানে তিনি সংক্ষেপে 'আল্লাহর ওলী' এর বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন:
.
"আল্লাহ তাআ’লা ওলী হওয়ার গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ
.
)أَلا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ(
.
“মনে রেখো যে, আল্লাহর ওলীদের না কোন আশঙ্কা আছে, আর না তারা বিষন্ন হবে। তারা হচ্ছে সেই সব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করে চলে।” (সূরা ইউনুসঃ ৬২-৬৩) ঈমান এবং তাকওয়া আল্লাহর ওলী হওয়ার প্রধান আলামত। সুতরাং যে মুমিন হবে এবং আল্লাহকে ভয় করে চলবে, সেই আল্লাহর অলী বা বন্ধু। যারা আল্লাহর সাথে শির্ক করবে, তারা আল্লাহর বন্ধু নয়; বরং তারা আল্লাহর শত্রু। আলাহ বলেনঃ
.
)مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ(
.
“যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল, তাঁর ফেরেশতাগণের, জিবরীলের এবং মিকাঈলের শত্রু হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ এরূপ কাফেরদের শত্রু।” (সূরা বাকারাঃ ৯৮)
.
সুতরাং যে কোন মুসলিম গাইরুলাহর কাছে দু’আ করবে অথবা গাইরুলাহর কাছে এমন বিষয়ে ফরিয়াদ করবে, যে বিষয়ে তার কোন ক্ষমতা নেই, সে কাফের-মুশরিকে পরিণত হবে। সে কখনই আল্লাহর ওলী হতে পারে না। যদিও সে তা দাবী করে থাকে। বরং তাওহীদ, ঈমান এবং তাকওয়া বিহীন তার এ দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা।
.
মুসলমান ভাইদের প্রতি আমার উপদেশ হল, তারা যেন ভন্ড ওলীদের মাধ্যমে প্রতারিত না হয় এবং সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব এবং ছহীহ হাদীছের দ্বারস্ত হয়। তবেই তাদের আশা-ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপরই হবে এবং মানসিক প্রশান্তি ও স্থিরতা লাভ করবে। এতে ভন্ডদের হাত থেকে তাদের ধন-সম্পদও হেফাজতে থাকবে। তেমনিভাবে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতকে আকঁড়ে ধরার মধ্যে রয়েছে তাদেরকে ধোকার পথ হতে দূরে রাখার ব্যবস্থা। যারা কখনো নিজেদেরকে সায়্যেদ আবার কখনো ওলী হিসাবে দাবী করে, আপনি যদি তাদেরকে নিয়ে চিন্তা করেন, তবে দেখতে পাবেন যে, তারা আল্লাহর ওলী বা সায়্যেদ হওয়ার গুণাগুণ হতে সম্পূর্ণ দূরে। প্রকৃত পক্ষে যিনি আল্লাহর ওলী হবেন, তিনি নিজেকে ওলী হিসাবে প্রকাশ করা থেকে দূরে থাকবেন। আপনি তাকে পরহেজগার মুমিন হিসাবে দেখতে পাবেন। তিনি প্রকাশ করবেন না। তিনি মানুষের মাঝে ওলী হিসাবে প্রকাশিত হন বা মানুষ তার দিকে ধাবিত হোক, কোনটাই পছন্দ করবেন না। কোন মানুষ যদি এতটুকু কামনা করে যে, লোকেরা তাকে সম্মান করুক, তার কাছে এসে ভীড় করুক, তাহলে এটা হবে তাকওয়া এবং ওলী হওয়ার পরিপন্থী। যে ব্যক্তি মূর্খদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা আলেমদের সাথে বিতর্ক করা কিংবা লোকদেরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য ইলম অর্জন করবে, তার জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে কঠিন সতর্ক বাণী এসেছে। যারা নিজেদেরকে ওলী হিসাবে দাবী করে এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, তারা প্রকৃত ওলীর গুণাগুণ হতে অনেক দূরে।
.
মুসলমান ভাইদের প্রতি আমার নসীহত হল, তারা যেন এ সমস্ত ভন্ডদের থেকে সাবধান থাকেন এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহর দিকে ফিরে এসে আল্লাহকেই একমাত্র আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল হিসাবে গ্রহণ করেন।"[১৮]
.
.
লেখাটিতে কোনোরূপ ভুল-ত্রুটির জন্য আল্লাহ মার্জনা করুন এবং শিরক-কুফর-বিদআত থেকে মুক্ত করে আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সহিহ ইসলামিক আকিদায় অটল থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
.
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةًۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْوَهَّابُ
.
"হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে বক্র করে দিও না এবং তোমার নিকট থেকে আমাদেরকে করুণা দান কর। নিশ্চয় তুমি মহাদাতা।"[১৯]
.
______________________
তথ্যসূত্র:
[১] তাফসিরে আহসানুল বয়ান/আল-কোরআন ১০:৬২ আয়াতের ব্যাখ্যা হতে বিবৃত
[২] আবূ দাঊদ ৩৫২৯ (বিশুদ্ধ সনদে);
হাদিসের মানঃ সহিহ;
source - http://www.hadithbd.com/share.php?hid=67312
[৩] আল-কোরআন, ১০:৬২-৬৪;
বাংলা অনুবাদ - তাইসিরুল কুরআন
[৪] আল-কোরআন, ৩৯:৩;
বাংলা অনুবাদ - বয়ান ফাউন্ডেশন
[৫] আল-কোরআন, ২:১৮৬;
বাংলা অনুবাদ - মুজিবুর রহমান
[৬] আল-কোরআন, ৩৫:১৩-১৪;
বাংলা অনুবাদ - তাফসিরে আহসানুল বয়ান
[৭] গ্রন্থঃ কুরআন ও হাদীছের মানদন্ডে সুফীবাদ/অধ্যায়ঃ সূফীবাদ/অলী-আওলীয়াদের আহবান;
লেখক: আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী;
উৎস - http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=1632
[৮] গ্রন্থঃ দ্বীনী প্রশ্নোত্তর/অধ্যায়ঃ আকিদা'হ ও তাওহীদ;
লেখক: আব্দুল হামীদ ফাইযী;
উৎস - http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=7
[৯] গ্রন্থঃ হাদীসের নামে জালিয়াতি/অধ্যায়ঃ ৮. মিথ্যা হাদীস বিষয়ক কিছু বিভ্রান্তি/৮. ২. আলিম-বুজুর্গগণের গ্রন্থ বনাম জাল হাদীস;
লেখক: ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর;
উৎস - http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=4659
[১০] আল-কোরআন, ৬:৯৩;
বাংলা অনুবাদ - মুহিউদ্দিন খান
[১১] গ্রন্থঃ হাদীসের নামে জালিয়াতি
অধ্যায়ঃ ৮. মিথ্যা হাদীস বিষয়ক কিছু বিভ্রান্তি/৮. ৩. ২. হাদীস বিচারে কাশফের কোনো ভূমিকা নেই;
লেখক: ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর;
উৎস - http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=4662
[১২] আল-কোরআন, ৩:৪৯;
বাংলা অনুবাদ - তাফসিরে আহসানুল বয়ান
[১৩] তাফসিরে আহসানুল বয়ান/আল-কোরআন ৩:৪৯ আয়াতের ব্যাখ্যা হতে বিবৃত
[১৪] আল-কোরআন, ৮৬:১৩-১৪;
বাংলা অনুবাদ - তাইসিরুল কুরআন
[১৫] তাফসিরে আহসানুল বয়ান/আল-কোরআন ১০:৬২ আয়াতের ব্যাখ্যা হতে বিবৃত
[১৬] আল-কোরআন, ৪৩:৩৬;
বাংলা অনুবাদ - তাইসিরুল কুরআন
[১৭] গ্রন্থঃ যাদুকর ও জ্যোতিষীর গলায় ধারালো তরবারি/অধ্যায়ঃ ইসলামে যাদুর হুকুম/কেরামত, মু'জেযা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য;
লেখক: ওয়াহীদ বিন আব্দুস সালাম বালী;
উৎস - http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=5882
[১৮] গ্রন্থঃ ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম/অধ্যায়ঃ ঈমান/(৭২) কাউকে আল্লাহর ওলী ভেবে তার কাছে বিপদে উদ্ধার কামনা করার জন্য ফরিয়াদ করা কি? আল্লাহর ওলী হওয়ার সঠিক আলামত কি?
মুফতি: শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন
উৎস - http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=603
[১৯] আল-কোরআন, ৩:৮;
বাংলা অনুবাদ - তাফসিরে আহসানুল বয়ান
==================
লেখক: আহমেদ আলি
Comments
Post a Comment