[মুসলিম-অমুসলিম সকলেই লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে একটু চিন্তা করার অনুরোধ রইল]
.
.
"ভাই, আপনি ইবাদত করেন কেন?"
.
"বলেন কী ভাই! ইবাদত না করলে জান্নাতে যাব কী করে!"
.
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনতর উত্তরের সাথেই আমরা বেশি পরিচিত। তবে আমি বলব, উত্তরটি পুরোপুরি সঠিক নয় বা সম্পূর্ণ নয়!
.
ভালোভাবে চিন্তা করুন! যদি আপনার ইবাদতের উদ্দেশ্য হয় কেবল জান্নাত প্রাপ্ত করা, তাহলে আপনি আসলে কার ইবাদত করছেন? আল্লাহ তায়ালার নাকি আপনার নাফস এর? আপনার কামনা বাসনার?
.
আপনি আল্লাহ এর ইবাদত করেন - এ কথা মুখে বলছেন। কিন্তু আপনার মনে আছে যে, আপনি যদি ইবাদত করেন, তার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। তাহলে আপনার সাথে আল্লাহ তায়ালার সম্পর্ক কি ব্যবসায়িক লেনদেনের মত যে, আপনি আল্লাহকে ব্যবহার করছেন শুধুই জান্নাত পাওয়ার খাতিরে???
(নাউজুবিল্লাহ)
.
আমার কথাগুলো হয়ত ভালো লাগছে না। কিন্তু এটাই সত্য যে, আমাদের বর্তমান মুসলিম সমাজের চিন্তাধারা আল্লাহর রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর সাহাবাদের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে নি। আর তাই আমরা আজ পদে পদে ইসলামের সত্য ও সৌন্দর্য হতে দূরে সরে যাচ্ছি!
.
লক্ষ্য করুন, এই একই ধরণের প্রশ্ন যখন আল্লাহর রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) - কে করা হয়, তখন তিনি কী বললেন!!!
.
"‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে এত অধিক সালাত আদায় করতেন যে, তাঁর পদযুগল ফেটে যেতো।
.
**‘আয়িশাহ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ্ তো আপনার আগের ও পরের ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? তবু আপনি কেন তা করছেন?**
.
**তিনি বললেন, আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়া পছন্দ করব না?**
.
তাঁর মেদ বর্ধিত হলে (অর্থাৎ তিনি বার্ধক্যে পৌঁছলে) তিনি বসে সালাত আদায় করতেন। যখন রুকু করার ইচ্ছে করতেন, তখন তিনি দাঁড়িয়ে কিরাআত পড়তেন, তারপর রুকূ‘ করতেন।"
.
[সহীহ বুখারী (তাওহীদ)/অধ্যায়ঃ ৬৫/কুরআন মাজীদের তাফসীর (كتاب التفسير)/হাদিস নম্বরঃ ৪৮৩৭/হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih);
source - http://www.hadithbd.com/share.php?hid=29351]
.
.
হাদিসটি ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। আল্লাহর রাসূল জানতেন যে, আল্লাহ তাঁর পূর্বের ও পরের সমস্ত ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দিয়েছেন!
.
এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন:
.
"যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন।"
(আল-কোরআন, ৪৮:২)
.
ইবনে কাসির এই আয়াতের তাফসিরে এক স্থানে বলছেন,
.
"এমন কোনো বিশুদ্ধ হাদিস নেই যেখানে বলা হচ্ছে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি তার কৃত সৎকর্মের জন্য অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত পাপ এর ক্ষমা প্রাপ্ত হয়েছিলেন...."
.
"There is not an authentic Hadith that states that any person other than the Messenger earned forgiveness for all of his sins of the past and future on account of performing good deeds...."
.
[Taken from Tafsir of Ibn Kathir/Explanation on Al-Quran, 48:2]
.
তাহলে আল্লাহর রাসূল জানতেন যে, তার সমস্ত পাপ ও ত্রুটিসমূহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাই তাঁর তো ইবাদত না করলেও চলত! তারপরও তিনি ইবাদতে অটল ছিলেন কেন??? আল্লাহর রাসূল এই প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিচ্ছেন যে, তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়া পছন্দ করবেন। অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার সেই বান্দাদের অন্তভুক্ত তিনিও হতে চান, যারা তাঁর প্রতি সর্বদা কৃতজ্ঞ।
.
তাহলে এখানে আল্লাহর রাসূলের ইবাদতের উদ্দেশ্য কী? জান্নাত প্রাপ্তি? না, বরং আল্লাহর সেই সমস্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যাঁরা বিনিময়ের কোনো প্রত্যাশা ব্যতীতই আল্লাহর প্রতি সর্বদা অনুগত ও কৃতজ্ঞ।
.
এরূপ বান্দাদের অন্তরে থাকে আল্লাহর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা যা তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে এরূপ চিন্তাধারা:
.
"... 'নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার উপাসনা (কুরবানী), আমার জীবন ও আমার মরণ, বিশ্ব-জগতের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য।'"
(আল-কোরআন, ৬:১৬২)
.
আর তাই আল্লাহর প্রতি প্রকৃত অর্থে এরূপ কৃতজ্ঞ বান্দাদের পরিমাণ সত্যিই খুব কম। একারণে মহান আল্লাহ বলছেন,
.
"...আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।"
(আল-কোরআন, ৩৪:১৩)
.
.
কিন্তু এরপরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। যদি বলা হয় যে, ইবাদতের আসল উদ্দেশ্য আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া, তাঁকে সন্তুষ্ট করা, তাঁর প্রতি নিবেদিত হওয়া; তাহলে জান্নাত বা জাহান্নামের কী দরকার ছিল? আল্লাহ তো শুধু আমাদেরকে ইবাদতের নির্দেশ দিলেই পারতেন??
.
এর উত্তর হল, যদি আল্লাহ তায়ালা আপনাকে শুধু ইবাদতের নির্দেশ দিয়েই ছেড়ে দিতেন, তাহলে আপনার মত লোকেরা ইবাদত প্রায় ছেড়েই দিত। কারণ সে তখন ইবাদত করতে বাধ্য থাকত না, যেমনভাবে পরীক্ষা না থাকলে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই পড়াশুনা ছেড়ে দিত!
.
ব্যাপারটা আরেকটু বিশদে দেখা যাক।
.
ইসলাম ঘোষণা করছে যে, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে সীমার মধ্যে কিছুটা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন নিজের পথ বেছে নেওয়ার এবং আপনি নিজেই এই মনুষ্য জীবন বেছে নিয়েছেন যখন আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে আপনাকে সৃষ্টির পূর্বে নিজের ইচ্ছা অনুসারে জীবন বেছে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন।
.
"আমি আসমান, যমীন ও পর্বতের প্রতি (ইসলামের বোঝা বহন করার) আমানাত পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল, তারা তাতে আশংকিত হল, কিন্তু মানুষ সে দায়িত্ব নিল। সে বড়ই অন্যায়কারী, বড়ই অজ্ঞ।"
(আল-কোরআন, ৩৩:৭২)
.
স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন এই শ্রেষ্ঠতর মনুষ্য জীবন স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়ার কারণে আপনি এখন ইবাদতের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন।
.
"যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য - কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।"
(আল-কোরআন, ৬৭:২)
.
তাই আপনি নিজের ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর নিকট তাঁর নির্দেশিত পথে নিজেকে সমর্পণও করতে পারেন, অথবা, নিজ সত্ত্বার ওপর অত্যাচার করে আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধাচরণও করতে পারেন।
.
আর তাই ইবাদতের এই পরীক্ষার সঠিক বিচারের জন্যই আল্লাহ তায়ালা জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন যাতে করে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তার কৃতকর্মের যোগ্য প্রতিদান প্রদান করা সম্ভব হয়।
.
তবে একটি বিষয় এখানে লক্ষ্যণীয়!
আপনি যতই এভাবে চিন্তা করুন না কেন যে, আপনার ইবাদতের উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহ তায়ালাকেই সন্তুষ্ট করা, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ও নিবেদিত থাকা; তবুও এই পার্থিব জীবনের ইবাদতের পরীক্ষার কারণে আপনি জান্নাতের প্রত্যাশা থেকে মুক্ত হতে পারবেন না।[1]
তাই ইবাদতের মধ্যে আপনি বিনিময় বা প্রত্যাশাবিহীন ইবাদত করতে প্রায় অসমর্থ। কিন্তু আখিরাতে আল্লাহর ইচ্ছায় জান্নাত প্রাপ্তির পর ইনশা আল্লাহ আপনার ইবাদত হয়ে উঠবে প্রত্যাশা ও বিনিময় মুক্ত, কেননা তখন আল্লাহর ইচ্ছায় পার্থিব জগতের জটিলতা অতিক্রম করতে আপনি সক্ষম হবেন এবং আল্লাহ তায়ালা সেই সমস্ত ভালোবাসা, প্রেম, দয়া আপনার ওপর অবতীর্ণ করবেন যা তিনি এই দুনিয়ার পরীক্ষা ও জটিলতার মধ্যে অবতীর্ণ করেন নি।
.
‘‘আল্লাহ তা‘আলা আসমান যমীন সৃষ্টি করার দিন একশটি রহমত সৃষ্টি করলেন। প্রতিটি রহমত আসমান ও যমীনের মধ্যস্থল পরিপূর্ণ (বিশাল)। অতঃপর তিনি তার মধ্য হতে একটি রহমত পৃথিবীতে অবতীর্ণ করলেন। ঐ একটির কারণেই মা তার সন্তানকে মায়া করে এবং হিংস্র প্রাণী ও পাখিরা একে অন্যের উপর দয়া ক’রে থাকে। অতঃপর যখন কিয়ামতের দিন হবে, তখন আল্লাহ এই রহমত দ্বারা সংখ্যা পূর্ণ করবেন।’’
.
[বুখারী ৬০০০, মুসলিম ৭১৪৮-৭১৫১;
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
source - http://www.hadithbd.com/share.php?hid=63972]
.
.
তাই আসুন, আমাদের চিন্তাধারাকে উন্নত করি এবং আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের মিষ্টতা ও সৌন্দর্য অনুভবের চেষ্টা করি।
.
লেখায় কোনোরূপ ভুল-ত্রুটির জন্য আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করুন এবং আমাদের সকলকে হিদায়েতের পথে পরিচালিত করুন। আমিন।
.
.
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِى عَنِّى فَإِنِّى قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا۟ لِى وَلْيُؤْمِنُوا۟ بِى لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
.
"আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন তুমি বল, আমি তো (তাদের) সন্নিকটেই আছি। যখন কোন আহবানকারী আমাকে ডাকে, তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিই। অতএব তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমাতে বিশ্বাস স্থাপন করুক, যাতে তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত হতে পারে।"
.
(আল-কোরআন, ২:১৮৬)
.
.
_____________________
[1] ইসলাম অনুযায়ী মায়া আর মোক্ষলাভ এর কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই জান্নাত লাভের চিন্তাটা ইসলামে কোনো নীচু স্তরের চিন্তা নয় যেহেতু ইসলামে অদ্বৈতবাদের কোনো স্থান নেই। কোনো কোনো বিকৃত সুফি আকিদায় অদ্বৈতবাদের যে সমর্থন করা হয়েছে, তা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর আকিদার বিজ্ঞ আলিমদের সম্মতিক্রমে প্রত্যাখাত হয়েছে। একারণে ধ্যান, যোগসাধনা প্রভৃতির মাধ্যমে ব্রহ্মচর্য, বৈরাগ্য ইত্যাদির ধারণাকে ইসলাম ভ্রান্ত পথ এবং মুশরিকি আকিদা হিসেবে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর তাই ইসলামিক মতবাদে একমাত্র সহিহ আকিদার অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এর আকিদাই সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য।
.
.
إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلْإِسْلَٰمُۗ وَمَا ٱخْتَلَفَ ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ ٱلْكِتَٰبَ إِلَّا مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْعِلْمُ بَغْيًۢا بَيْنَهُمْۗ وَمَن يَكْفُرْ بِـَٔايَٰتِ ٱللَّهِ فَإِنَّ ٱللَّهَ سَرِيعُ ٱلْحِسَابِ
.
"নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন হল ইসলাম। বস্তুতঃ যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল, তারা জ্ঞান লাভের পর একে অন্যের উপর প্রাধান্য লাভের জন্য মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করবে, (সে জেনে নিক) নিশ্চয়ই আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অতিশয় তৎপর।"
(আল-কোরআন, ৩:১৯)
.
.
লেখক: আহমেদ আলি
[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...
Comments
Post a Comment