এই বিষয়টা নিয়ে এতটা জটিলতা হয়ত চার ইমামের কেউ-ই পাকান নি যতটা আমাদের বর্তমানের মুসলিম সমাজের ভাই-বোনেরা দিন দিন ভালো মত পাকিয়ে যাচ্ছেন!
.
আমার মতে, মাযাহাব মানা ফরজ কথাটা সঠিকও যেমন, ভুলও তেমন!
.
হয়ত ভাবছেন, একইসাথে কোনো বিষয় সঠিক এবং ভুল হয় কী করে!
.
তাহলে লক্ষ্য করুন - মাযাহাবের উদ্দেশ্য কি বিভেদ সৃষ্টি করা? না, কারণ আপনি আমি ভালো করেই জানি যে, উম্মাহ এর মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হারাম। মহান আল্লাহ বলছেন:
.
وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُوا۟ وَٱخْتَلَفُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَٰتُۚ وَأُو۟لَٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
.
"তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর (বিভিন্ন দলে) বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।"
(আল-কোরআন, ৩:১০৫)
.
তাহলে মাযাহাবের আসল উদ্দেশ্য কী? ইসলামকে সেইভাবে বুঝতে সাহায্য করা যেভাবে আল্লাহর রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বুঝিয়েছেন ও সাহাবাগণ বুঝেছেন।
.
"....তোমরা যদি না জান তাহলে তোমরা আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে যারা অবগত তাদেরকে জিজ্ঞেস করো।"
(আল-কোরআন, ১৬:৪৩)
.
তবে কেউ যদি কোনো মাযাহাবের অনুসরণ না করে, আপনি তাকে ইসলাম হতে বহির্ভূত বলতে পারেন না। চার ইমামের পূর্বে কোন্ মাযাহাব ছিল? নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোন্ মাযাহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন? তাহলে কে মাযাহাবকে ফরজ করল? একজন সত্য বিশ্বাসী মুমিন এর প্রকৃত পরিচয় কেবলই "মুসলিম", মাযাহাবি নয়!
.
"...তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’।" (আল-কোরআন, ২:১৩২)
.
"....বলে দাও, 'তোমরা এ বিষয়ে সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম'।" (আল-কোরআন, ৩:৬৪)
.
"....(হাওয়ারীগণ বলল) 'তুমি(ঈসা(আ)) সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম’।" (আল-কোরআন, ৩:৫২)
.
তাই কেউ যদি মাযাহাবের অনুসরণ না করে, আপনি তাকে গালিগালাজ বা নিন্দা করতে পারেন না। আপনি বড়জোর তাকে কোনো একটা মাযাহাবের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন।
.
তাহলে মাযাহাব মানা যে ফরজ - এটা কোন্ দিক দিয়ে সঠিক?
.
এটা বোঝার জন্য এই আয়াতটি দেখুন:
.
"...বলো, 'যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান'।" (আল-কোরআন, ৩৯:৯)
.
অর্থাৎ, জ্ঞানী এবং মূর্খ ব্যক্তি সমান নয়। এক্ষেত্রে সকলের পক্ষে এটা সম্ভব নয় যে, সে নিজের প্রচেষ্টায় জ্ঞানচর্চায় দক্ষতা অর্জন করবে। যেমন স্কুলে পড়লেও প্রাইভেট টিউশন নিতে হয়, খুব কম ছাত্র-ছাত্রীই পাওয়া যাবে যারা কোনো ভালো শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই কেবল নিজের প্রচেষ্টায় পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে। একারণেই জ্ঞান অর্জনের জন্য সাধারণভাবে একজন শিক্ষকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
মাযাহাবের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই। এমন কোনো নিশ্চয়তা আপনি প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে দিতে পারবেন না যে, সে কেবল নিজের প্রচেষ্টাতেই ইসলামের তত্ত্বকে সেইভাবে বুঝে ফেলবে যেভাবে সাহাবাগণ বুঝেছিলেন। আর তাই মাযাহাব এখানে অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয় যা অগ্রাহ্য করা যায় না।
.
"....তোমরা যদি না জান তাহলে তোমরা আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে যারা অবগত তাদেরকে জিজ্ঞেস করো।"
(আল-কোরআন, ১৬:৪৩)
.
আমাদের আহলে হাদিস বা সালাফি ভাইয়েরা তুমুল ঝড় তুলে যেভাবে মাযাহাবের নিন্দা করে যাচ্ছেন, তারা কি এটা অস্বীকার করবেন যে, আহলে হাদিস বা সালাফি মানহাজও একটা দল, একটা মাযাহাব?
.
তাহলে কেন শুধু শুধু আমরা নিজেদের মাযাহাবি, লা-মাযাহাবি বলে গালিগালাজ করছি। হতে পারে, আপনি কোনো কোনো ব্যাখ্যার সাথে একমত নন। এজন্য বিতর্কও স্বাভাবিক। কিন্তু এর জন্য গালিগালাজ, অভিশাপ কেন?
.
আমাদের মূল সমস্যাটা হল অন্ধ অনুসরণে। কোনো একটি দলের অনুসরণ এর অর্থ এই না যে, সেই দলের ব্যাখ্যাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে হবে। বরং আমাদের উচিৎ ইল্ম বৃদ্ধির সাথে সাথে ইসলামকে নিজে থেকে যাচাইয়ের চেষ্টা করা এবং গঠনমূলক বিতর্কে জড়ালেও উত্তম ব্যবহার, শিষ্টাচার ইত্যাদি বজায় রাখা।
.
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন:
.
إنْ تَوَجَّهَ لَكُمْ دَلِيلٌ فَقُولُوا بِهِ
.
‘‘যদি তোমরা কোনো দলীলকে গ্রহণযোগ্য বলে দেখতে পাও তবে সে দলীলের ভিত্তিতেই মত প্রদান করবে।’’
.
[ইবন আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ১/৬৭;
উৎস: http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=7068]
.
.
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) আরও বলেছেন:
.
هذا رأي النعمان بن ثابت يعني نفسه وهو أحسن ما قدرنا عليه فمن جاء بأحسن منه فهو أولى بالصواب
.
‘‘এ হলো নুমান ইবন সাবিতের (অর্থাৎ তাঁর নিজের) মত। আমাদের ক্ষমতা ও সাধ্যের মধ্যে আমরা এ মতটিই সবচেয়ে ভাল বলে মনে করেছি। কেউ যদি এর চেয়ে ভাল মত দিতে পারেন তবে সেটিই অধিক গ্রহণযোগ্য ও সঠিক বলে গণ্য হবে।’’
.
[শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/২০৩; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৫২; নুমান ইবন মাহমূদ আলূসী, জালাউল আইনাইন, পৃ. ২০৩;
উৎস: http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=7068]
.
.
"আলিম-গবেষকদের জন্য ইজতিহাদী মাসাইলে ইমামের সব কথা নির্বিচারে গ্রহণ করা বা ‘নির্বিচার তাকলীদ’ করার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি করতেন ইমাম আবূ হানীফা।
.................
....লক্ষণীয় যে, ইমাম আবূ হানীফা এ ব্যক্তির অপরাধ গৌণ বলে গণ্য করেছেন। তবে মূলত এটি অপরাধ। হাদীসটি সহীহ কি না এবং এর বিপরীতে সহীহ হাদীস আছে কিনা তা গবেষণা না করে একটি হাদীসকে সহীহ শুনেই গ্রহণ করা মুমিনকে বিভ্রান্ত করতে পারে। ফিকহী মাসআলার ন্যায় হাদীসের মান নির্ধারণে অন্ধ তাকলীদও নিন্দনীয়।"
.
[গ্রন্থঃ আল-ফিকহুল আকবর/অধ্যায়ঃ ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার/মাযহাব ও তাকলীদ/উৎস: http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=7068]
.
.
শাইখ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ তাঁর একটি ফতোয়ায় বলেছেন:
.
"....কোনো দল বা সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা বলতে যদি তার প্রতি অন্ধভক্তি ও গোঁড়ামি বুঝায়, অর্থাৎ সে যে সংগঠন করে, সেটিই একমাত্র হকের উপর আছে, পক্ষান্তরে অন্যগুলি ভ্রান্তির মধ্যে আছে বলে মনে করে এবং শুধুমাত্র নিজ সংগঠনের কর্মীদের সাথে আন্তরিকতা বজায় রেখে চলে, আর অন্যদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে, তাহলে এটি একদিকে যেমন মহা অন্যায় এবং যুলম। অন্যদিকে তেমনি এগুলি দ্বারা উম্মতের মধ্যে বিভক্তি এবং দুর্বলতা সৃষ্টি ব্যতীত আর কিছুই হয় না। সেজন্য প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির উচিৎ, সকল মুমিন ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা বজায় রেখে চলা। মহান আল্লাহ বলেন,
.
﴿ إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ﴾ [المائدة: ٥٥]
.
‘তোমাদের বন্ধুতো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ’ (আল-মায়েদাহ ৫৫)।
.
তিনি আরো বলেন,
.
﴿ إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ ﴾ [الحجرات: ١٠]
.
‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই’ (আল-হুজুরাত ১০)।
.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই’।
.
অতএব, আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতির সাথে ঐক্যমত পোষণকারী দল, জামা‘আত বা সংগঠনগুলির কোনো একটির মধ্যে হক সীমাবদ্ধ বলে মনে করা যাবে না। আল্লাহর পথে দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজন। প্রত্যেকটি মুমিন অন্যান্য মুমিনের সাথে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা বজায় রেখে চলবে। নিকটের হোক বা দূরের হোক সৎকাজে একে অপরকে সহযোগিতা করবে এবং অন্যায় কাজে সহযোগিতা থেকে বিরত থাকবে।"
.
[গ্রন্থঃ দল, সংগঠন, ইমারত ও বায়‘আত সম্পর্কে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের বক্তব্য/অধ্যায়ঃ (১১) মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ/প্রশ্ন: প্রচলিত বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের কোনো একটিতে যোগ দেওয়া কি একজন মুসলিমের উপর আবশ্যকীয়?/উৎস: http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=5309]
.
.
তাই আসুন, নিজেদের আচরণ পরিবর্তন করার চেষ্টা করি এবং আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হই।
.
وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا۟ۚ وَٱذْكُرُوا۟ نِعْمَتَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَآءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِۦٓ إِخْوَٰنًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ ٱلنَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَاۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمْ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
.
"তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (ধর্ম বা কুরআন)কে শক্ত করে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর; তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের (দোযখের) প্রান্তে ছিলে, অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তা হতে তোমাদেরকে উদ্ধার করেছেন। এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার।"
.
(আল-কোরআন, ৩:১০৩)
=====================
.
লেখক: আহমেদ আলি
[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...
Comments
Post a Comment