হিন্দুদের প্রায়ই এই ধরণের প্রশ্ন করতে দেখা যায় যেগুলো দিয়ে তারা বলে যে, যদি কোরআন সমস্ত মানব জাতির জন্য আসত, তাহলে সেখানে কোনো ভারতীয় বা এশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় নবী বা রাসূলের বর্ণনা থাকত। আর তারপর তারা যে দাবিটা করে সেটা হল, কোরআন, বাইবেল এগুলো হল আব্রাহামিক(নবী ইব্রাহীমের) ধর্মীয় মতবাদের অনুসরণে রচিত যেগুলো মূলত ইতিহাসনির্ভর, কিন্তু বৈদিক দর্শন কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা সর্বকালের সকল সৃষ্টির জন্য।
.
হিন্দু দর্শন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় কোনো মুসলিম এগুলো শোনার পর আর কোনো জবাবই দিতে পারে না। তখন সে বাধ্য হয়ে প্রবৃত্তির প্ররোচনায় হিন্দুধর্মের নিন্দা করা শুরু করে।
.
আমার মতে এই দাবির জবাব সূক্ষ্মভাবে আল্লাহ তায়ালা কোরআন এর বিভিন্ন আয়াতে দিয়েছেন।
.
.
♦ পৃথিবীতে বহু পয়গম্বর বা নবী-রাসূল আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছেন:
.
কোরআন বলছে,
.
"...এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ৩৫:২৪)
.
"নিশ্চয় আমি অনেক রসূলের কথা পূর্বে তোমার নিকট বর্ণনা করেছি এবং অনেক রসূলের কথা তোমার নিকট বর্ণনা করিনি..."
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ৪:১৬৪)
.
অর্থাৎ পৃথিবীতে বিভিন্ন স্থানে নবী-রাসূল এসেছেন তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়কে সতর্ক করার জন্য; আর তাই তাদের নির্দেশগুলোও ছিল সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য। তবে সকলের বর্ণনা কোরআনে দেওয়া হয় নি।
.
তাফসিরে আহসানুল বয়ানে আল-কোরআন, ৪:১৬৪ এর তাফসিরের একটি অংশে বলা হচ্ছে:
.
"....কুরআন ও সহীহ হাদীস থেকে শুধু এতটুকু বুঝা যায় যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলায় যুগে যুগে মহান আল্লাহ নবী ও রসূলগণকে সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রূপে প্রেরণ করেছেন। অতঃপর নবুঅতের সেই ধারাবাহিকতা শেষ হয় মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে। কিন্তু শেষনবী (সাঃ)-এর পূর্বে নবী ও রসূলের সংখ্যা কত? এর সঠিক উত্তর আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। পক্ষান্তরে শেষনবী (সাঃ)-এর পরে যত নবুঅতের দাবী করেছে বা করবে, তারা সকলেই দাজ্জাল ও মিথ্যুক। আর তাদের মিথ্যা নবুঅতের অনুসারীগণ ইসলামের গন্ডি হতে খারিজ...."
[তাফসিরে আহসানুল বয়ান,
source - https://goo.gl/w6rESk]
.
সুতরাং, শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পূর্বে যেহেতু পৃথিবীতে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ এর পক্ষ থেকে সত্যের বার্তাবাহক এসেছিল, তাই বলা যায়, সত্যের বার্তাবাহক নবী-রাসূলগণ ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় অংশেও এসেছিলেন। কিন্তু যেহেতু কোরআন বা সহিহ হাদিসে এর কোনো সুস্পষ্ট বিবরণ নেই, তাই আমরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না, সেই বার্তাবাহক আসলে কে বা কারা ছিলেন এবং প্রেরিত ঐশ্বরিক গ্রন্থটাই বা কী ছিল!
.
.
♦ পূর্ববর্তী ঐশ্বরিক বার্তার বিকৃত অবস্থা:
.
কোরআন বলছে,
.
فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ يَكْتُبُونَ ٱلْكِتَٰبَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنْ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشْتَرُوا۟ بِهِۦ ثَمَنًا قَلِيلًاۖ فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا يَكْسِبُونَ
.
"সুতরাং তাদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজ হাতে গ্রন্থ রচনা করে এবং অল্প মূল্য পাবার জন্য বলে, ‘এটি আল্লাহর নিকট হতে এসেছে।’ তাদের হাত যা রচনা করেছে, তার জন্য তাদের শাস্তি এবং যা তারা উপার্জন করেছে তার জন্যও তাদের শাস্তি (রয়েছে)।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২:৭৯)
.
অর্থাৎ পূর্ববর্তী ঐশ্বরিক বার্তা মানুষ পার্থিব তুচ্ছ স্বার্থে বিকৃত করে ফেলেছে। আর তাই ইসলামিক আকিদায় প্রাচ্য এবং ভারতীয় দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ঐশ্বরিক গ্রন্থ বলে যেগুলো দাবি করা হয়, তার মূল বক্তব্যও আজ বিকৃত।
.
.
♦ কোরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত:
.
যেহেতু পূর্ববর্তী বার্তাবাহকগণ কেবল তাদের সময়ের সম্প্রদায়ের জন্য এসেছিলেন এবং সময়ের পরিক্রমায় তা বিকৃত হয়ে যায়, তাই কোরআন এর বক্তব্য অনুযায়ী, সর্বশক্তিমান আল্লাহ সমস্ত বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে তাঁর সর্বশেষ বাণীসমষ্টি আল-কোরআন-কে সর্বশেষ বার্তাবাহক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন:
.
تَبَارَكَ ٱلَّذِى نَزَّلَ ٱلْفُرْقَانَ عَلَىٰ عَبْدِهِۦ لِيَكُونَ لِلْعَٰلَمِينَ نَذِيرًا
.
"কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি তাঁর দাস(মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)) এর প্রতি ফুরকান(সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী আল-কোরআন) অবতীর্ণ করেছেন। যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২৫:১)
.
যেহেতু আল-কোরআন সমস্ত মানবজাতির জন্য এসেছে, তাই এর মেয়াদ পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত এবং তাই আল্লাহ তায়ালা নিজেই এই বাণীকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করবেন।
.
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا ٱلذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ
.
"নিশ্চয় আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ৫৪:১৭)
.
অর্থাৎ, কোরআনের নির্দেশনাবলি একেবারে সুস্পষ্ট যেটা পড়ে বা শুনে অজ্ঞ লোক থেকে শুরু করে পণ্ডিত ব্যক্তি পর্যন্ত সকলেই খুব সহজে বুঝতে পারে, আল্লাহ তায়ালা আসলে আমাদের কাছ থেকে কী চাইছেন বা আমাদেরকে কী নির্দেশ দিচ্ছেন!
.
এখানে তাই মূল উদ্দেশ্য হল সত্য পথ প্রদর্শন। যদি ভারতীয় বা এশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় কোনো নবী বা রাসূলের বর্ণনা দেওয়া হত, তাহলে সেই বর্ণনাকে সুস্পষ্ট করার জন্য সেই অঞ্চলের ধর্মীয় মতবাদকে প্রথমে তুলে ধরতে হত এবং তারপর সেগুলোর বিশ্লেষণ করে তার জবাব দিতে হত। যেমন, যদি ভারতের কোনো নবীর বর্ণনা দেওয়া হত, তাহলে আগে ভারতীয় দর্শনের বর্তমান ধারণাগুলো যেমন আত্মার অবিনাশিতাবাদ, অবতারবাদ, জন্মান্তরবাদ, "মায়া" এর ধারণা ইত্যাদির বর্ণনা দিয়ে সেই প্রসঙ্গে যুক্তিমূলক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়াত। ফলে কোরআন এর বিষয়বস্তু অনেক জটিল হয়ে উঠত এবং সকলের পক্ষে বিশেষ করে সাধারণ জনগণের পক্ষে সহজে বিষয়বস্তু আয়ত্ত করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হত না। আর তখন কোরআনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যেত। একারণে আল্লাহ তায়ালা সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করার জন্য ঠিক ততটুকু বর্ণনাই বেছে নিয়েছেন বিবৃত করার জন্য, যতটুকুর মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তিই খুব সহজে বুঝতে পারে যে, তার কর্তব্যটা আসলে কী।
.
.
♦ কোরআনের বিষয়বস্তু:
.
আল্লাহ বলেন,
.
وَلَقَدْ أَنزَلْنَآ إِلَيْكُمْ ءَايَٰتٍ مُّبَيِّنَٰتٍ وَمَثَلًا مِّنَ ٱلَّذِينَ خَلَوْا۟ مِن قَبْلِكُمْ وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ
.
"আমি তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ, তোমাদের পূর্ববর্তীদের কিছু দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহ ভীরুদের জন্যে দিয়েছি উপদেশ।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২৪:৩৪)
.
এখান থেকে দেখা যায়, কোরআন এর বিষয়বস্তুকে আল্লাহ তায়ালা তিন ভাগে ভাগ করেছেন:
.
১) আল্লাহ তায়ালার আয়াত,
২) পূর্ববর্তীদের কিছু দৃষ্টান্ত,
৩) আল্লাহ ভীরুদের জন্য উপদেশ।
.
'আল্লাহর আয়াত' এই শব্দগুচ্ছের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসির বলেন,
"And indeed We have sent down for you Ayat that make things plain,
.
meaning, in the Qur'an there are Ayat which are clear and explain matters in detail."
.
[From Tafsir of the Quran, 24:34 by Ibn Kathir; source - https://goo.gl/w6rESk]
.
অর্থাৎ, 'আল্লাহর আয়াত' হল কোরআনে বর্ণিত আল্লাহ তায়ালার সেই বাণী যা বিষয়বস্তুকে বিশদে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে।
.
এর পাশাপাশি আরও দুটি বিষয়কে বলা হয়েছে যেটি হল পূর্ববর্তীদের কিছু দৃষ্টান্ত (যা প্রকৃতপক্ষে আগের নবী-রাসূলদের ইতিহাসকে তুলে ধরে) এবং আল্লাহ ভীরুদের জন্য উপদেশ।
.
এই তিনটি বিষয়কে একত্র করে বলা যায়, কোরআন হল এমন একটি গ্রন্থ যেখানে মহান আল্লাহ সত্যের নিদর্শনকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন এবং দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্যবহার করেছেন পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের বিশদ ইতিহাস থেকে নির্দিষ্ট কিছু বাছাই করা বর্ণনা যাতে করে এর দ্বারা সত্যের নিদর্শনের তাৎপর্যকে মানুষের নিকট পরিষ্কার ভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং যারা আল্লাহ ভীরু, তাদেরকে এর মাধ্যমে সঠিক উপদেশ ও নির্দেশনা প্রদান করা যায়।
.
অর্থাৎ কোরআন এর বিষয়বস্তু কেবল ইতিহাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং ইতিহাসের বিবৃতি এর সমগ্র বিষয়বস্তুর একটি অংশ মাত্র।
.
.
♦ ভারতীয় দর্শনের মূল ভিত্তির সাথে তুলনা:
.
প্রাচ্যের ধর্মীয় মতবাদগুলির প্রায় সবই কোনো না কোনো ভাবে ভারতীয় দর্শন তথা আর্য দর্শন তথা বৈদিক দর্শনের সাথে সম্পর্কিত। কোরআন যে প্রাচ্যের জন্যও প্রেরিত হয়েছে, তা বোঝা যাবে যদি কোরআনের মাধ্যমে ভারতীয় দর্শনের ধারণাগুলির ওপর যথাযথ জবাব প্রদান করা সম্ভব হয়।
.
তবে ভারতীয় দর্শনের প্রত্যেকটি মতবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই রচনাটি অনেক বেশি জটিল এবং দীর্ঘ হয়ে উঠবে। তাই কেবল ভারতীয় দর্শনের সেই সকল ধারণাগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল যেগুলির ওপর এই দর্শনের মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে:
.
.
=> আত্মার অবিনাশিতাবাদ:
.
আর্যদর্শনের মূল স্তম্ভ যে ধারণার ওপর বিশেষভাবে দাঁড়িয়ে আছে তা হল আত্মার অবিনাশিতাবাদ। আর্যদর্শন অনুযায়ী, ঈশ্বর হলেন পরমাত্মা এবং তাঁর অংশ থেকে আত্মা পৃথক হয়ে তা ধ্বংসশীল দেহে প্রবেশ করে। আর তাই আমরা আসলে আত্মা, দেহ নই। আর যেহেতু পরমাত্মা হল ঈশ্বর এবং ঈশ্বর অবিনশ্বর, তাই আত্মাও অবিনশ্বর (যেহেতু আত্মা, ঈশ্বর বা পরমাত্মার অংশ)।
.
ভগবতগীতা বলছে,
"সমস্ত শরীরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে যে অক্ষয় আত্মা, জেনে রেখ তাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।"
(ভগবতগীতা, ২:১৭)
.
এখান থেকেই শুরু হয়েছে ঈশ্বরের সাথে সৃষ্টির তুলনা। ইসলাম একে ঘোষণা করছে "শির্ক" হিসেবে এবং একে বর্ণনা করছে সর্বোচ্চ অপরাধ ও চূড়ান্ত পথভ্রষ্টতা রূপে।
.
আত্মা ঈশ্বরের অংশ হলে, প্রকৃতপক্ষে তিনি আর সৃষ্টিকর্তাই থাকবেন না, কেননা তিনি তখন তাঁর নিজ অংশের রূপান্তর করবেন মাত্র, শুন্য থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি করার কোনো ক্ষমতাই তখন তাঁর থাকবে না।
.
মহান সৃষ্টিকর্তা তাই ঘোষণা করছেন,
.
"তারা তাঁর পরিবর্তে কত উপাস্য গ্রহণ করেছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না এবং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং নিজেদের ভালও করতে পারে না, মন্দও করতে পারে না এবং জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনেরও তারা মালিক নয়।"
.
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২৫:৩)
.
.
"তবে কি যিনি সৃষ্টি করেন তিনি তারই মত যে সৃষ্টি করে না? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?"
.
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ১৬:১৭)
.
.
তাই আত্মা যে অবিনশ্বর নয়, এটা কেবল সৃষ্টিকর্তার একটি সৃষ্টি এবং তাই সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছা করলে এই আত্মাকেও ধ্বংস করতে পারেন - এই উত্তরটি তিনি ঘোষণা করছেন সুস্পষ্টভাবে নিমোক্ত প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে:
.
.
"ভূপৃষ্ঠে (অস্তিত্বপূর্ণ) যা কিছু আছে সব কিছুই নশ্বর;
অবিনশ্বর শুধু তোমার প্রতিপালকের সত্ত্বা যিনি মহিমাময়, মহানুভব।
অতএব, তোমরা উভয়ে(মানুষ ও জ্বিন) তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?"
.
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ৫৫:২৬-২৮)
.
.
=> মায়া ও সৃষ্টিকর্তার ধারণা:
.
ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী, সব কিছুই হল ঈশ্বরের অংশ, ঈশ্বর হল পরমাত্মা, আর তার থেকে পৃথক হয়ে আসে আত্মা, আর আমরা হল সেই আত্মা। যেহেতু ঈশ্বর অবিনশ্বর, আর আত্মা ঈশ্বরের অংশ, তাই আত্মাও অবিনশ্বর। অর্থাৎ, আমরা প্রকৃতপক্ষে আত্মা, আর আমরা অবিনশ্বর। কিন্তু আমরা যে ঈশ্বরের অংশ আর আমরাও অবিনশ্বর, তা আমরা বুঝতে পারি না, কারণ আমরা যে দেহ ধারণ করে আছি তা ধ্বংসশীল, আর তাই আমরা নিজেদের ধ্বংসশীল দেহ ভাবা শুরু করি যেখানে এই ভাবনাটা আমাদের অজ্ঞতা, একে বলা হয় "মায়া", আর মায়ার কারণে তাই আমরা যে ঈশ্বরের অংশ, তা বুঝতে পারি না।
.
যদি সব কিছু ঈশ্বরের অংশ হয়, তার মানে ঈশ্বর কেবল নিজের অংশের রূপান্তর করে আমাদের তৈরি করার ক্ষমতা রাখেন, শূন্য থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা তার নেই।
.
"হে পান্ডব, এই ভাবে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তুমি আর মোহগ্রস্ত হবে না যখন জানবে **সমস্ত জীবই আমার বিভিন্ন অংশ** এবং তারা আমাতেই অবস্থিত এবং তারা সকলেই আমার।"
(ভগবতগীতা, ৪:৩৫)
.
আমরা আরও নিশ্চিত হই যে, ভারতীয় দর্শনে আসলে কোনো সৃষ্টিকর্তার বিবরণ নেই যখন বিবেকানন্দের লেখা দেখি যেখানে তিনি এই অযুহাত দিয়েছেন যে, সৃষ্টিকর্তার ধারণা মানুষের সুখ দু:খের কারণ এর সমাধান করতে পারে না।
.
"....if they are all created, why does a just and merciful God create one happy and another unhappy, why is He so partial? Nor would it mend matters in the least to hold that those who are miserable in this life will be happy in a future one. Why should a man be miserable even here in the reign of a just and merciful God?
In the second place, ***the idea of a creator God does not explain the anomaly***, but simply expresses the cruel fiat of an all-powerful being...."
[Complete Works of Vivekananda, Volume 1/Addresses at The Parliament of Religions/Paper on Hinduism;
spurce - https://en.m.wikisource.org/wiki/The_Complete_Works_of_Swami_Vivekananda/Volume_1/Addresses_at_The_Parliament_of_Religions/Paper_on_Hinduism]
.
তাহলে কোনো সত্য সৃষ্টিকর্তার ধারণা ভারতীয় দর্শনে পাওয়া যায় না। তাই মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর সর্বশেষ ঐশী বাণী আল-কোরআনে বলেন,
.
"যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী; তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি; সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন অংশীদার নেই। *তিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে।*
.
***আর তারা তাঁর পরিবর্তে উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছে অপরকে *যারা কিছুই সৃষ্টি করেনা,* বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট*** এবং তারা নিজেদের অপকার অথবা উপকার করার ক্ষমতা রাখেনা এবং জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপরও কোন ক্ষমতা রাখেনা।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২৫:২-৩)
.
নবীজী ছিলেন নিরক্ষর, লিখতে, পড়তে কিছুই পারতেন না, তাই এটা তাঁর পক্ষে সম্ভব না অন্য গ্রন্থ পড়ে তার ওপর কমেন্ট করা, তাঁর ওপর মক্কার লোকজন ছিল কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এর মানে এটাই দাঁড়ায় এই জবাব তাঁর পক্ষ থেকে যিনি প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা।
আমরা আরও বুঝতে পারি, যখন বলা হয় যে, মানুষকে ঈশ্বরের অংশ থেকে না, শুন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে।
.
The Noble Quran, Surah Maryam, 19:67,
.
(Bengali Translation - Mujibur Rahman)
.
"মানুষ কি স্মরণ করেনা যে, আমি তাকে পূর্বে সৃষ্টি করেছি ***যখন সে কিছুই ছিল না?"***
.
English Translation - Yusuf Ali
.
"But does not man call to mind that We created him before ***out of nothing?"***
.
.
"তিনি আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এবং যখন তিনি কোন কাজ সম্পাদন করতে ইচ্ছা করেন ***তখন তার জন্য শুধুমাত্র ‘হও’ বলেন, আর তাতেই তা হয়ে যায়।"***
(The Noble Quran, Surah Al-Baqarah, 2:117)
.
.
=> "ঈশ্বরের লীলা" এর ধারণা:
.
ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী, ঈশ্বর তাঁর নিরাকার অবস্থাকে সাকার রূপে প্রকাশ করে জগত তৈরি করলেন এবং সেই জগতকে মায়ার মধ্যে আবদ্ধ করে খেলা শুরু করলেন যা "লীলা-খেলা" বা শুধু "লীলা" নামেও পরিচিত। এ সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর একটি গানে বলেছেন:
.
"খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।।"
.
স্বামী বিবেকানন্দ এই লীলা সম্পর্কে বলেন এভাবে:
.
"...We have a theory that the universe is God's manifestation of Himself just for fun, that the Incarnations came and lived here 'just for fun'. Play, it was all play. Why was Christ crucified? It was mere play. And so of life. Just play with the Lord. Say, "It is all play, it is all play". Do you do anything?"
.
[Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 8/Sayings and Utterances;
source - https://en.m.wikisource.org/wiki/The_Complete_Works_of_Swami_Vivekananda/Volume_8/Sayings_and_Utterances]
.
.
দৃঢ় বক্তব্যে মহান সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাই এই ভ্রষ্ট ধারণার জবাবে ঘোষণা করছেন:
.
.
وَمَا خَلَقْنَا ٱلسَّمَآءَ وَٱلْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَٰعِبِينَ
.
"আকাশ ও পৃথিবী এবং যা এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।"
.
لَوْ أَرَدْنَآ أَن نَّتَّخِذَ لَهْوًا لَّٱتَّخَذْنَٰهُ مِن لَّدُنَّآ إِن كُنَّا فَٰعِلِينَ
.
"আমি যদি ক্রীড়ার উপকরণ চাইতাম তাহলে আমি আমার নিকট যা আছে তা দিয়েই ওটা করতাম, আমি তা করিনি।"
.
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২১:১৬-১৭)
.
.
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَٰكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ
.
"তোমরা কি ভেবেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে তামাশার বস্তু হিসেবে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না?"
.
فَتَعَٰلَى ٱللَّهُ ٱلْمَلِكُ ٱلْحَقُّۖ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ ٱلْعَرْشِ ٱلْكَرِيمِ
.
"সুউচ্চ মহান আল্লাহ যিনি প্রকৃত মালিক, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ নেই, সম্মানিত আরশের অধিপতি।"
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২৩:১১৫-১১৬)
.
.
♦উপসংহার:
এই আলোচনা থেকে তাই বলা যায়, ইসলাম কেবল ইতিহাসের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কোরআন বা হাদিসে কোনো ভারতীয় বা পূর্বাঞ্চলীয় নবীর বর্ণনা না থাকার অর্থ এটা নয় যে, ইসলামিক মতপথ প্রাচ্যের জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং সত্যকে সুস্পষ্টভাবে এবং যথাযথভাবেই মহান আল্লাহ সমগ্র মানবজাতির জন্য তুলে ধরেছেন যা ঘোষিত হয়েছে চিরন্তন বিধানরূপে।
.
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ
.
"তিনি তাঁর রাসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্যধর্ম নিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে একে সবধর্মের উপর প্রবল করে দেন যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।"
.
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ৬১:৯)
.
.
আহমেদ আলি সিরিজ/ভারতবর্ষে নবী ও রাসূল
Comments
Post a Comment