কোন ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে - এটা আগে থেকে জানা সত্ত্বেও কেন আল্লাহ তায়ালা উক্ত ব্যক্তিকে জাহান্নামে ঠেলে দেবেন???
ভাগ্য নিয়ে এক ভাই একটা জটিল ধরণের প্রশ্ন করেছিলেন যে প্রশ্নটা আমার মনেও বেশ কিছু দিন আগে এসেছিল। আল্লাহ এর রহমতে সেই প্রশ্নের উত্তর আমার মনে চলে আসে। সেই ভাই এর প্রশ্ন ও তার উত্তরে আমার কমেন্টের অংশটুকু তাই সকলের উদ্দেশ্যে এই পোস্টে দিলাম।
.
.
প্রশ্ন: ধরুন "ক" একজন ব্যক্তি। আল্লাহ আগে থেকেই জানেন সে খারাপ কাজ করবে, তাই তার তাকদিরে (ভাগ্যে) খারাপটাই লেখা আছে। আর সে খারাপ কাজ করছে। বিচার হবে পরকালে, আর তাকে শাস্তি পেতে হবে জাহান্নামে অনন্তকাল যার কোন সীমা নেই। আচ্ছা এই (পৃথিবীর) মাত্র 60-70 বছরের জন্য তাকে অনন্তকাল আযাব (শাস্তি) ভোগ করতে হবে? আল্লাহ তো আগে থেকেই জানেন যে সে খারাপ কর্ম করবে। তাহলে আল্লাহ আগে থেকে জানা সত্ত্বেও তাকে জাহান্নামে পাঠাচ্ছেন ???
.
.
আমার কমেন্ট:
ভাই যে প্রশ্নটা করেছেন, এটা অনেক আগে আমার মনেও এসেছিল। এগুলো আসলে শয়তানের প্ররোচনা। আপনাকে প্রশ্নটার যুক্তিযুক্ত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, উত্তরটাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য আমাদের আল্লাহ এর কাছে সাহায্য চাইতে হবে, আর আল্লাহর শরণাপন্ন হয়ে তাঁর জিকিরে মগ্ন হতে হবে। কারণ যতক্ষণ না, আপনার অন্তর আল্লাহ অভিমুখী হচ্ছে, ততক্ষণ আপনার মনে শয়তানের এরকম প্ররোচনা আসতেই থাকবে আর আপনি হতাশার আগুনে জ্বলতে থাকবেন, আর আল্লাহ তায়ালাকে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবিচারক বলে মনে হতে শুরু করবে। নাউজুবিল্লা, তিনি অণু পরিমাণও অবিচার করেন না।
.
এবার আপনার প্রশ্নের উত্তরে আসি। ধরুন, কোনো ইঞ্জিনিয়ার একটা শক্তিশালী যন্ত্র বানালেন, তার উদ্দেশ্য হল সেটা যেন জনসাধারণ এর কল্যাণে আসে। যেমন ধরুন মোবাইল বা ইন্টারনেটও ধরা যায়, পারমাণবিক শক্তির ফর্মূলাও ধরা যায়। এগুলো আবিষ্কার করা হয়, প্রয়োগ করা হয়, নতুন নতুন জিনিস তৈরি করা হয় মানবকল্যাণের জন্য। কিন্তু যারা এগুলো তৈরি করছেন, তারা কিন্তু এগুলোর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্ভাব্য কি কি হতে পারে সেগুলোও জানতেন বা অনুমান করে বলতে পারবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেগুলো তারা তৈরি করেন বৃহত্তর কল্যাণের জন্য। এখন যদি ধরি পরমাণুর ফিশন এর ফর্মূলা মানব কল্যাণে শক্তি উৎপাদনের কাজে লাগানোর পরিবর্তে কেউ বোমা বানিয়ে নিরীহ মানুষ মারার কাজে লাগাল, তাহলে এবার আপনি কাকে ধরবেন দোষী হিসেবে? সেই বিজ্ঞানীকে যে এই পারমাণবিক ফর্মূলা তৈরি করেছেন, নাকি সেই ব্যক্তিকে যে ভুলভাবে সেটা কাজে লাগিয়েছে?? নিশ্চয়ই সেই ভুলভাবে ফর্মূলা কাজে লাগানো ব্যক্তিকে। এখানে আপনি বলতে পারেন না, দোষ বিজ্ঞানীর, সে ফর্মূলা বানালো কেন! কারণ তার উদ্দেশ্য ছিল কল্যাণকর। এখানে যদি কোনো ব্যক্তি ভুল পথে সেটাকে কাজে লাগায়, তাহলে দোষ সেই ব্যক্তিরই !
.
একই ভাবে, আল্লাহ তায়ালাও জানেন আপনি কী করবেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা জানেন বলেই দোষটা আপনি তাঁকে দিতে পারেন না, কারণ আল্লাহ তায়ালা কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন, এমন এক সৃষ্টি যা স্বাধীনভাবে চিন্তা করে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করবে দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে। এই বৃহত্তর স্বার্থের পথে যদি কেউ হারাম পথে গিয়ে বিগ্নতা সৃষ্টি করে, তাহলে এর জন্য আল্লাহ কেন তাঁর সৃষ্টিকার্য থামাবেন??? আপনার পাপের জন্য আপনি আল্লাহকে দায়ী করে তাঁকে হুকুম করতে পারেন না, কারণ আপনার ক্ষমতা এতই সামান্য যা তুলনাও করা যায় না, সেখানে মহান আল্লাহ যিনি তুলনার উর্ধ্বে, তাঁর সিদ্ধান্তে ত্রুটি খোঁজার আপনি কে???
.
আর যদি ত্রুটি ধরাই হয়, তাহলে এর জন্য আপনিই দায়ী! কেন আপনি মনুষ্য জীবন বেছে নিয়ে নিজের ইচ্ছায় এই পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন?
এখন নিজের ইচ্ছায় এই পরীক্ষা বেছে নিয়ে আল্লাহকেই আবার দোষারোপ করছেন!!!
.
"আমি আসমান, যমীন ও পর্বতের প্রতি (ইসলামের বোঝা বহন করার) আমানাত পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল, তারা তাতে আশংকিত হল, *কিন্তু মানুষ সে দায়িত্ব নিল। সে বড়ই অন্যায়কারী, বড়ই অজ্ঞ।"*
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ৩৩:৭২)
.
"We did indeed offer the Trust to the Heavens and the Earth and the Mountains; but they refused to undertake it, being afraid thereof: *but man undertook it;- He was indeed unjust and foolish;-"*
(The Noble Quran, 33:72)
.
.
এর অর্থ হল, আমাদের সামনে option দেওয়া হয়েছিল, আর আমরাই এই মনুষ্য জীবন বেছে নিয়েছি। প্রায় অন্যান্য সৃষ্টিগুলো already মুসলিম, অর্থাৎ তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের ইচ্ছা সমর্পণকারী, (যেহেতু "মুসলিম" শব্দের অর্থ যে নিজের ইচ্ছাকে সৃষ্টিকর্তার নিকট সমর্পণ করে শান্তি অর্জনের জন্য), যেমন, সূর্যের চারদিকে পৃথিবী নির্দিষ্ট মহাকর্ষ সূত্রের নিয়ম মেনে ঘুরছে, এর ব্যতিক্রম নেই, এখানে তাই সূর্য, পৃথিবী already সৃষ্টিকর্তার নিকট আত্মসমর্পণকারী।
একই ভাবে, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতও সৃষ্টিকর্তার নিকট আত্মসমর্পণকারী।
.
কিন্তু মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে, সে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ মানতেও পারে, নাও পারে। আর তাই এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে যাচাই ও বিচার করা প্রয়োজন। যেমন ধরুন, কেউ নিজের ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে কারো মা-কে ধর্ষণ করল। এবার এই ইচ্ছাশক্তির সঠিক যাচাই ও বিচার প্রয়োজন। আর তাই এই জীবনে সে সুযোগ পাবে তার কাজ করার এবং সে যদি তার পাপ এর জন্য ক্ষমা না চায় ও সঠিক পথে ফিরে না আসে, তবে অবশ্যই তার ইচ্ছাশক্তির অপপ্রয়োগের জন্য সে পরকালের চিরস্থায়ী জীবনে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হবে।
.
আর যদি কেউ সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার নিকট নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করে জীবনযাপন করে, তবে পরকালের প্রকৃত জীবনেও সে চির সুখের স্থানে প্রবেশ করবে।
.
কিন্তু মানুষ নিজের ভোগ বিলাসিতার কারণে সত্যকে মেনে নিতে চায় না, আর সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধাচারণ করে, আর তাই আল্লাহ বলছেন যে, *কিন্তু মানুষ সে দায়িত্ব নিল। সে বড়ই অন্যায়কারী, বড়ই অজ্ঞ*
এখানে মানুষ নিজের ইচ্ছায় অন্য সৃষ্টিদের থেকে শ্রেষ্ঠতর হওয়ার জন্য এই মনুষ্য জীবন বেছে নিয়েছে, আর তাই এই জীবনের পরীক্ষার জন্য আমরাই দায়ী, সৃষ্টিকর্তা নন।
.
আর তাই মহান স্রষ্টা ঘোষণা করছেন,
.
*"মানুষ কি মনে করেছে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি(সত্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি)’ এ কথা বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবেনা?
আমিতো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী।"*
.
(মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, ২৯:২-৩)
তাই ভাই, শয়তান আর নাফসের লোভনীয় প্ররোচনা ছেড়ে আসুন আমরা মহান আল্লাহ এর শরণাপন্ন হই, তিনি চাইলে ইহকাল ও পরকালের সমস্ত বাধা দূর হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।
.
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন।
.
.
আহমেদ আলি সিরিজ/ভাগ্যের জটিলতা সংক্রান্ত অভিযোগের জবাব
Comments
Post a Comment