Skip to main content

'আল্লাহকে তো চোখে দেখি না। তাহলে চোখে না দেখে বিশ্বাস করবো কীভাবে? যা চোখে দেখা যায় না তা কী বিশ্বাসযোগ্য?'


সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি আমাকে প্রায়ই হতে হয়, উপরের প্রশ্নটি তার মধ্যে একটি।
এই প্রশ্নটি যারা করে, তারা মনে করে যে দুনিয়ার সকল দর্শন, বিজ্ঞান আর যুক্তিবিদ্যা তারা গুলিয়ে খেয়ে বসে আছে।
তারা মনে করে আস্তিকদের দিকে তারা এমন একটি যুক্তি ছুঁড়ে দিয়েছে, যাতে করে দুনিয়ার সকল আস্তিক একেবারে কাৎ হয়ে পড়ে গেছে।
প্রথমত, তারা দুনিয়ার এমন অনেক কিছুতে বিশ্বাস করে, যা তারা মূলত চোখে দেখে না।
যেমন ধরুন - ভালোবাসা, মায়া, মহব্বত, দুঃখ, ব্যথা ইত্যাদি।
কোন অবিশ্বাসী যদি বলে, - 'আমি অমুককে ভালোবাসি।'
তাকে যদি আমি প্রশ্ন করি- 'ভালোবাসা আবার কী জিনিস?'
সে তখন আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাবে। বলবে,- 'এটা আবার কেমন প্রশ্ন?'
যদি বলি,- 'ভালোবাসা দেখা যায়?'
সে বলবে,- 'না'
- 'ছোঁয়া যায়?'
- 'না'
- 'খাওয়া যায়?'
- 'না'
- 'ভালোবাসার স্বর শোনা যায়?'
- 'না'
- 'ভালোবাসার ঘ্রাণ নেওয়া যায়?'
- 'না'
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেক পরীক্ষায় 'ভালোবাসা' তার অস্তিত্ব প্রমাণে ব্যর্থ। ডাহা ফেইল। তাহলে কী আমরা কনক্লুশনে আসবো যে ভালোবাসা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই?
একইভাবে মায়া, মহব্বত, সুখ, দুঃখের অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই?
আবার ধরুন- বাতাস। বাতাস কী আমরা চোখে দেখি? দেখি না। যেহেতু বাতাসকে আমরা চোখে দেখিনা, তার মানে কী এটাই যে বাতাস বলে কিছু নেই?
এবার হয়তো অবিশ্বাসী ভদ্রলোক বেঁকে বসবেন। বলবেন,- 'ধুর! আমি কী বলেছি যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না? কিছু কিছু ব্যাপার আছে উপলব্ধির, অনুভবের। ভালোবাসা, মায়া, মহব্বত এসব উপলব্ধির ব্যাপার। এসব চোখে দেখা না গেলেও উপলব্ধিতে ধরা পড়ে। এগুলোকে ফিল করা যায়। স্রষ্টাকে কী ফিল করা যায়?'
দেখা যাচ্ছে ভদ্রলোক পুরোপুরি ইউ-টার্ন নিয়ে নিলেন। প্রথমেই তিনি কিন্তু 'চোখে দেখে বিশ্বাস' এর ব্যাপারে জ্ঞান জাহির করেছিলেন।
যাহোক, ভালোবাসাকে আমরা চোখে দেখি না। কিন্তু একে অন্যের প্রতি টান, মমত্ব দেখে আমরা বুঝতে পারি পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কিছু আছে। এটাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না, শোনা যায় না, খাওয়া যায় না, এটার টক,মিষ্টি ঘ্রাণ নেই।
তাহলে এটার কী আছে? আকার? আকৃতি? নাহ, কিচ্ছু নেই। তবুও এটা আছে। এটাকে যদিওবা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ছাঁচে ফেলে মাপা যায় না, তবুও আমরা জানি পৃথিবীতে 'ভালোবাসা' বলে কিছু আছে।
কীভাবে জানি? উপলব্ধির মাধ্যমে।
বাতাস আছে আমরা কীভাবে বুঝি? বাতাসের গুণের মাধ্যমে। কর্মের মাধ্যমে। কীরকম?
বাতাসে গাছের পাতা দুলে উঠে, বাতাস হলে আমাদের গায়ে ঠান্ডা অনুভূত হয় ইত্যাদি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীতে আমরা ভালোবাসার অস্তিত্ব টের পাই কীভাবে? ভালোবাসার গুণের মাধ্যমে, কর্মের মাধ্যমে। একে-অন্যের প্রতি যে আত্মিক টান, মমত্ববোধ - এটা থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে পৃথিবীতে 'ভালোবাসা' বলে কিছু একটা আছে।
আবার গাছের পাতা দুলে উঠা, গায়ে শিরশিরে অনুভূতি থেকে বুঝতে পারি বাতাসের অস্তিত্ব।
এই জিনিসগুলোকে চোখে না দেখেও, না স্পর্শ করেও আমরা জাস্ট উপলব্ধি করে বুঝে নিই যে এরা আছে।
স্রষ্টার ব্যাপারটাও ঠিক এমন। মানুষ চাইলেই স্রষ্টাকে দেখতে পারবে না।
না দেখেই বুঝে নিতে হবে তার অস্তিত্ব যে তিনি আছেন। সেটা কীভাবে? অবশ্যই স্রষ্টার সিফাত, গুণ এবং কর্মের মাধ্যমে।
পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানীরা মিলে ল্যাবরেটরীতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আজ অবধি একটি প্রাণ কণা তৈরি করতে পারেনি।
নিজের শরীরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একটু পরিমাণ অক্সিজেন কিনতে আপনাকে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হয়, অথচ না চাইতেই কেউ একজন প্রতিদিন আপনাকে অঢেল পরিমাণ অক্সিজেন ফ্রিতে দিচ্ছেন? কে সে?
সামান্য ইঞ্জুরড হলেই হাসপাতালগুলোতে রক্তের জন্য হাহাকার চলে। অথচ কখনো চিন্তা করেছেন আপনার শরীরে যতো লিটার রক্ত আছে, তার জন্য সেই রক্তদাতাকে কতো টাকা পরিশোধ করেছেন?
শাক-মাছ-মাংস যা-ই মুখে দেন, এক অপূর্ব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা মুখ হয়ে গলা বেয়ে, পেট থেকে পরিপাকতন্ত্রে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে সেটা ডাইজেস্ট হয়ে আমিষ, শর্করা ইত্যাদি হয়ে আপনার শরীরকে পরিপুষ্ট করে তুলছে।
আপনার চোখের দিকে তাকান। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে, মানুষের একটি চোখ ৭০০ টি সুপার ডিজিটাল ক্যামেরার সমান। এই চোখ কে দিয়েছে আপনাকে?
আপনার ব্রেইন সম্পর্কে জানেন? গবেষণা মতে, একজন মানুষের ব্রেইনের ক্ষমতা কয়েক শ সুপার কম্পিউটারের চাইতেও বেশি।
আপনার শরীরের DNA সম্পর্কে জানেন? নাস্তিক বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স DNA সম্পর্কে বলেছেন,-
‘There is enough information capacity in a single human cell to store the Encyclopaedia Britannica, all 30 volumes of it , three or four times over’.
অর্থাৎ, একটি DNA তে এতো পরিমাণ স্পেস আছে যেখানে চাইলেই আপনি ৩০ ভলিউমের ৩-৪ টি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা লিখে রাখতে পারবেন। একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র DNA সেলের মধ্যে এই ক্ষমতা কে দিয়েছে? কোন মানুষ? কোন বিজ্ঞানী? নাহ! কে তিনি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমরা এমন একজন দার্শনিকের শরণাপন্ন হতে পারি যাকে বিংশ শতাব্দীর নাস্তিকদের 'Spiritual Leader' বলা হতো। কিন্তু তিনি পরে নাস্তিকতা ছেড়ে আস্তিক হয়ে যান। তাঁর নাম Antony Flew..
DNA' র এই বিস্ময়কর কাজ দেখে তিনি বলেছেন,- ‘almost entirely because of the DNA investigations . What I think the DNA material has done is that it has shown, by the almost unbelievable complexity of the arrangements which are needed to produce ( life ), that intelligence must have been involved in getting these extraordinarily diverse elements to work together'
অর্থাৎ, DNA ইনভেস্টিগেশন থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রাণ (Life) সৃষ্টিতে অবশ্যই অবশ্যই Intelligence তথা বুদ্ধিমান সত্ত্বার উপস্থিতি আবশ্যক। সেই বুদ্ধিমান সত্ত্বা কে?
পৃথিবীর কোন বিজ্ঞানী? নাহ। তিনি হলেন স্রষ্টা।
এরকম মহাকাশের দিকে তাকান। গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সিগুলোর দিকে তাকান। প্রত্যেক জায়গায় আপনি দেখতে পাবেন তার সৃষ্টি রহস্য।
আপনি যেমন ভালোবাসা দেখতে পান না, হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারেন না, শুধু কিছু Sign দেখে উপলব্ধি করে বুঝে নেন যে 'ভালোবাসা' বলে কিছু আছে, ঠিক তেমনি স্রষ্টাকে আপনি দেখবেন না, স্পর্শ করতে পারবেন না। কিন্তু, তার সৃষ্টি দেখে আপনাকে ধরে নিতে হবে যে- তিনি আছেন।
'আল্লাহ থাকলে তাকে আমরা দেখি না কেনো' টাইপ প্রশ্ন করার জন্য আসলে দর্শন, বিজ্ঞান আর যুক্তিবিদ্যা পড়া লাগে না। আগেকার যুগের কাফির-মুশরিকরাও এই একই প্রশ্ন করতো।
কোরআনে বলা হচ্ছে,- 'স্মরণ করো, যখন তোমরা বলেছিলে, ‘হে মূসা! আমরা আল্লাহকে সরাসরি না দেখা পর্যন্ত তোমাকে কক্ষনো বিশ্বাস করবো না’
- সূরা বাক্বারা - ৫৫
আরেক জায়গায় বলা হচ্ছে-
'কিতাবধারীগণ তোমাকে আসমান থেকে তাদের সামনে কিতাব নিয়ে আসতে বলে। তারা তো মূসার কাছে এর চেয়েও বড় দাবী পেশ করেছিল। তারা বলেছিল- আমাদেরকে প্রকাশ্যে আল্লাহকে দেখাও।'
- সূরা আন নিসা- ১৫৩
এই যে আল্লাহকে সরাসরি দেখার যে দাবি আমাদের অবিশ্বাসী শ্রেণী উত্থাপন করে, এই দাবিটা তখনকার অবিশ্বাসীরাও করতো।
তাদের জন্যই কোরআন জবাব দিচ্ছে,-
'দৃষ্টি তার নাগাল পায় না বরং তিনিই সকল দৃষ্টি নাগালে রাখেন। তিনি অতিশয় সূক্ষ্মদর্শী, সকল বিষয়ে ওয়াকিবহাল।'
- সূরা আন'আম ১০৩
খেয়াল করুন, আল্লাহ বলছেন- 'দৃষ্টি তার নাগাল পায় না।'
কাদের দৃষ্টি? অবশ্যই মানুষের দৃষ্টি।
মানুষ তাঁর দৃষ্টি দিয়ে স্রষ্টাকে দেখা তো দূরের কথা। সৃষ্টি জগতের কতোকিছুই যে সে তাঁর দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারেনা তার ইয়ত্তা নেই।
যেমন- মানুষ সাধারণত ৩০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোই দেখতে পায়। ৩০০ থেকে কম হলে বা ৭০০ থেকে বেশি হলে সেই আলো মানুষ আর দেখতে পায় না।
এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এই চোখ দিয়ে স্রষ্টাকে দেখতে চাওয়াটা কেবলই বাতুলতা নয় কী?
.
লেখক: আরিফ আজাদ

Comments

Popular posts from this blog

মানহাজ ও মাযাহাব নিয়ে যত দ্বন্দ্বের জবাব....

[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...

কৃষ্ণ কি আল্লাহর নবী ছিল?

এই প্রশ্নটা আমাকেও করা হয়েছে সম্ভবত কয়েকবার। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরটা বড়ই জটিল। কারণ এর কোনো যথাযথ উত্তর আমাদের জানা নেই। যদি কৃষ্ণের গোপীদের সাথে লীলার কাজকে সত্য বলে...

Permission of Adultery and Fornication in Hinduism - Remaining Part

Read the previous part here: http:// uniqueislamblog.blogspot.com /2017/11/ permission-of-adultery-and-fornication.html ?m=1 => Condemning physical relationship outside marriage: Generally physical relationship outside marriage is condemned in Hindu Philosophy. Bhagabat Gita says, "There are three gates leading to this hell-**lust**, anger, and greed. Every sane man should give these up, for they lead to the degradation of the soul." (Bhagabat Gita, 16:21) ['Bhagabat Gita As It Is' by His Divine Grace A.C. Bhaktivedanta Swami Prabhupada] This verse indicates that lust or desire outside marriage can lead one to hell if it is not maintained properly. It is further mentioned in Yajur Veda, "O God, **cast aside a lover**, **who cohabits with another's wife** ; **a paramour having illicit connection with a domestic woman** ; **an unmarried elder brother suffering from the pangs of passion** ; younger brother who has married before his elder to ...