"তুমি কি তাকে দেখ না, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে?
তুমি কি মনে করো যে, তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বোঝে? তারা তো চতুস্পদ জন্তুর মত; বরং আরও পথভ্রান্ত!"
(আল-কোরআন, ২৫:৪৩-৪৪)
.
ব্যভিচারের মনস্তাত্ত্বিক পীড়া বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় যে, কেন এটা হারাম!
.
ব্যভিচারের ক্ষেত্রে বিপরীত লিঙ্গের সাহচর্য উপভোগ করার পূর্বে এবং পরে প্রতি বারই একবার হলেও নিজের অভ্যন্তরীণ ফিতরাত বা প্রকৃতি হতে এই কাজের বিরোধিতার আহবান আসে। কিন্তু নাফসের বিলাসিতা আর চাহিদা মিটাতে ব্যক্তি নিজের ওপর প্রতিবারই জুলুম বা অত্যাচার করে এবং নিজের ফিতরাতের সুপরামর্শকে জোর করে দমিয়ে বার বার হারাম উপভোগের দিকে ছুটে চলে।
.
এক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হল অসন্তুষ্টি বা সন্তুষ্টির অভাব (lack of satisfaction)।
প্রাথমিক ধাপে যৌনকার্যে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে ব্যক্তি বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়; ফলে এই আকর্ষণ থেকে কামনার সৃষ্টি হয়, আর এই কামনা থেকে মনে অসন্তোষ জন্ম নেয়! যতক্ষণ এই অসন্তোষ জাগ্রত থাকে, ততক্ষণ ব্যক্তির মনে এই কামনা নিবারণের প্রবল ইচ্ছা ক্রিয়াশীলতা লাভ করে। ব্যক্তি-চিত্তে বার বার এই চিন্তা আসে যে, সে হয়ত উপভোগের মাধ্যমে সন্তুষ্ট হতে পারবে। কিন্তু যখনই সে উপভোগের পিছনে ছোটে, সে পড়ে যায় আরেকটি ফাঁদে। এই কামনা মিটাতে ইন্দ্রিয়ের হারাম উপভোগ ব্যক্তিকে আরও অধিক হারে অসন্তুষ্ট করে তোলে।
ফলে বিবাহ বহির্ভূত সঙ্গীর সাথে অভিসারে মিলিত হলে সে কিছুটা স্বস্তি লাভ করেছে বলে মনে করে ঠিকই; কিন্তু সেই সঙ্গীর থেকে দূরে সরে এলেই সে পুনরায় যন্ত্রণা ভোগ করতে শুরু করে। এই অবস্থায় সে যদি তার সঙ্গীর সাথে শারীরিক উপভোগেও মত্ত হয়, তবুও সে শান্তি লাভ করতে পারে না। সে হাজার হাজার বার যৌনকার্য সম্পাদন করলেও প্রশান্তি অর্জন করতে পারে না। কারণ একটাই - তার অন্তর তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট আর অসন্তুষ্টির ফলে তার কাছে জগতটা অর্থহীন বলে মনে হতে শুরু করে!!
ফলে ব্যক্তির নিকট সৃষ্টিকর্তার চিন্তাও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হতে শুরু করে!
.
নাস্তিকতার গোঁড়াতেই এই ভোগবাদের বিষবাষ্পের সংস্পর্শ বিদ্যমান। ব্যক্তি, ভোগের হারাম পথে ছুটতে ছুটতে প্রথমে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে এবং সৃষ্টিকর্তার চিন্তা তার কাছে ভোগ-বিরোধী উদ্ভট সমস্যা বলে মনে হতে থাকে। আবার ভোগের পিছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তার মধ্যে তৈরি হয় চরম হতাশা আর নিজের প্রতি নিজের প্রবল ঘৃণা! এই পর্যায়ে ব্যক্তি মাদকাসক্তি, আত্মহনন ইত্যাদির পথ বেছে নেওয়ার মাধ্যমে এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। উপরন্তু নিজ সত্ত্বার প্রতি অত্যাচারের কুকর্ম থেকে নিজেকে বাঁচাতে সমস্ত হারাম কাজের দায়ভার সৃষ্টিকর্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পাপের দায়মুক্তির জন্য নাস্তিকতাকে আঁকড়ে ধরে সে!
.
এক্ষেত্রে দুটি পর্যায় লক্ষ্যণীয়: ভোগের প্রাথমিক এবং চরম পর্যায়।
উভয় ক্ষেত্রেই মূল যে বিষয়টি ঘুরে ফিরে আসছে, সেটা সেই একই অসন্তোষ বা সন্তুষ্টির অভাব! সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত বিধান থেকে মুক্ত হতে গিয়ে ব্যক্তি পড়ে যায় ভোগ-বিলাসিতার অন্য এক ফাঁদে! ফলে নাফসের বিলাসিতার আনন্দ অর্জন করতে গিয়ে ব্যক্তি কোনোভাবেই সেই ফাঁদের অসন্তুষ্টির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারে না!
.
.
ব্যক্তির এই অসন্তোষ দূর করার জন্য ইসলাম তাকে সোজা সাপটা পথ দেখিয়েছে। আর সেটি হল - অহংকার ও বিলাসিতার বিসর্জন দিয়ে প্রকৃত আন্তরিক তওবার দ্বারা নিজের শুদ্ধ প্রকৃতিতে ফিরে আসা! ভোগের শৃঙ্খলের অসন্তোষ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ তাআলার দাসত্বের প্রশান্তি বরণ করা! আত্মসন্তুষ্টির পিছনে না ছুটে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার নিকট ইবাদতের মাধ্যমে আনুগত্যের শির নত করা!
.
পার্থিব কামনার দ্বারা কখনই সন্তুষ্ট হওয়া যায় না - হোক সেটা হালাল কিংবা হারাম পথ!
হারাম বিষয়ে আল্লাহর স্মরণ বিলুপ্ত হয় বিধায় তা অত্যাধিক পীড়াদায়ক। কিন্তু হালাল বিষয়ে আল্লাহর স্মরণ থাকে বিধায় উপভোগের মধ্যে শান্তি মিশ্রিত অবস্থায় বিরাজ করে; কারণ অন্তরের সন্তুষ্টি আসে হৃদয়ের প্রশান্তির মাধ্যমে; আর প্রশান্তির একমাত্র উৎস হল আল্লাহর স্মরণ!
.
.
ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ ٱللَّهِۗ أَلَا بِذِكْرِ ٱللَّهِ تَطْمَئِنُّ ٱلْقُلُوبُ
.
"যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জেনে রেখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।"
(আল-কোরআন, ১৩:২৮)
.
কিন্তু এটা একেবারেই সুস্পষ্ট যে, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও পার্থিব কামনা মিটানো যায় না! তাই দুনিয়ার ভোগের মাধ্যমে পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হওয়ার চিন্তা ও চেষ্টা করা - দুটোই বৃথা!
.
ٱعْلَمُوٓا۟ أَنَّمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌۢ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِى ٱلْأَمْوَٰلِ وَٱلْأَوْلَٰدِۖ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ ٱلْكُفَّارَ نَبَاتُهُۥ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَىٰهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَٰمًاۖ وَفِى ٱلْءَاخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضْوَٰنٌۚ وَمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَآ إِلَّا مَتَٰعُ ٱلْغُرُورِ
.
"তোমরা জেনে রেখ যে, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক অহংকার প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়; ওর উপমা বৃষ্টি, যদ্বারা উৎপন্ন শস্য সম্ভার কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, অতঃপর ওটা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি ওটা পীতবর্ণ দেখতে পাও; অবশেষে ওটা খড়কুটায় পরিণত হয়। পরকালে (অবিশ্বাসীদের জন্য) রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং (সৎপথ অনুসারীদের জন্য রয়েছে) আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়।"
(আল-কোরআন, ৫৭:২০)
========================
- আহমেদ আলি
[Special thanks to brother Mainuddin Ahmad for providing some important reference] . মানহাজ অর্থ পথ (path) অথবা পদ্ধতিগত বা নিয়মগত বা প্রণালিগত বিদ্যা (Methodology)। মানহাজ বললে তাই তাকে দুই ভাবে ভাবা হয় - ১) সহিহ মানহাজ, ২) ভ্রান্ত বা বাতিল মানহাজ। . সহিহ মানহা...
Comments
Post a Comment